বিশ্ব বাবা দিবস
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩ ১১:৫৫ এএম
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৩ ১১:৫৬ এএম
বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সন্তানের এগিয়ে চলায় যার থাকে নীরব ভূমিকা তিনি হলেন বাবা। বাবার আদর্শ, মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা সন্তানের ওপর দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য বলা হয়ে থাকে-বাবার হাত ধরেই সন্তানের চলতে শেখা। সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা চিরকালের। আজ বিশ্ব বাবা দিবসে তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করা তরুণরা লিখেছেন নিজের বাবাকে নিয়ে-
বাবাই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু
বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন এনএনও গ্লোবালের ফাউন্ডার লাব্বী আহসান-
ছোটবেলায় বেশ বড় একটা ঘটনা ঘটেছিল। খেতে বসে বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া। বাবা আদরের কমতি রাখেননি। কিন্তু সেই আদর বেশিদিন সহ্য হয়নি। আমার জন্মদিনে তুচ্ছ এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাবা এমন মার মেরেছিল, ভেবেছিলাম মরেই যাব ওইদিন। বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় সেদিন থেকেই। ভয়ে বাবা থেকে দূরে থাকতাম। ট্রমায় চলে গিয়েছিলাম এক প্রকার। বাবা পুলিশ অফিসার। চাকরিসূত্রে একেক জায়গায় পোস্টিং। মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে নিয়ে ফিরে আসবেন রংপুরে। রংপুরেই জন্ম। এরপর বাবা মাঝেমধ্যে ছুটিতে আসতেন। যে কয়দিন বাসায় থাকতেন, অনেক ভয় নিয়ে থাকতাম।
মনে হতো পান থেকে চুন খসলেই বাবা আমাকে মারবে কিংবা বকা দেবে। হতোও তাই। যেহেতু বাবা ডিসিপ্লিন লাইফ লিড করেন, আমার কাছেও এমনই আশা করতেন। কিন্তু আমি সব সময়ই ব্যতিক্রমী কিছু করতে চেয়েছি। চুপিচুপি সব এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিতে অংশ নিতাম। দিন যতই যাচ্ছিল, বাসায় থাকা আমার জন্য ততই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কোভিডের সময় বাবা পোস্টিং নিয়ে রংপুরে চলে এলেন। আমি ছাড়লাম বাসা। চলে এলাম ঢাকায়। শুরু হলো স্ট্রাগল। চিন্তা থাকত কীভাবে সারভাইভ করা যায়। এরপর চাকরি পাওয়ার পর সাহস নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম বাবার সঙ্গে। বিপদে-আপদে বাবাকেই ফোন করা শুরু করলাম। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হতে লাগল। এখন বাবাই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমি এখন যখন বাসায় যাই ছুটিতে, বাসস্ট্যান্ডে নিতে আসে বাবা। আবার আমি ঢাকায় ফেরার সময় বাবা দাঁড়িয়ে থাকে বাসস্ট্যান্ডে। যতক্ষণ বাস দেখা যায় বাবা ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এই বাবা দিবসে বাবাকে বলতে চাই, বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি। সব ছেলের বেস্ট ফ্রেন্ড যেন হয় তাদের বাবা।
অপেক্ষায় থাকতাম বাবা কখন ফোন করবেন
বাবা দিবসে বাবার প্রতি অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহাত মাইশা অর্পা-
আমার সব আবদার ও আহ্লাদের খোরাক জোগান আমার বাবা। ছোট মেয়ে হিসেবে ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে সবচেয়ে বেশি আদর ও ভালোবাসা আমি পেয়ে থাকি। আমার যত ইচ্ছে সবকিছুই আজ পর্যন্ত বাবা পূরণ করেছেন। বাবা যেহেতু প্রবাসী; তাই বাবার সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে ওঠে না। বাবা যখনই দেশে আসেন তখনই আমার সব ইচ্ছে পূরণ করার চেষ্টা করেন। ছোটবেলায় যখন আকাশে প্লেন উড়ে যেতে দেখতাম তখন মনে হতো এই উড়োজাহাজে চড়েই বুঝি বাবা আসছেন আমার কাছে।
উড়োজাহাজ দেখলেই নিজের মধ্যে অন্যরকম আনন্দ কাজ করত। বাবা যখনই দেশে আসতেন- তখন আমার খুশির যেন কোনো বাঁধ থাকত না। বাবা দেশে আসার আগে থেকেই আমি আমার পছন্দের জিনিসের লম্বা লিস্ট পাঠিয়ে দিতাম বাবার কাছে। বাবাও আমার আবদার মেটাতে খুঁজে খুঁজে বের করে নিয়ে আসতেন আমার সেসব পছন্দের জিনিস। বাবা আর সাথে ঝুড়ি ঝুড়ি উপহার পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়তাম। সারা দিন বাবার সঙ্গেই থাকতাম। বাবা যখন প্রবাসে ফিরে যেতেন তখন আমার মধ্যে কাজ করত ভীষণরকমের শূন্যতা। বাবাকে প্রচুর মিস করতাম যখন তিনি চলে যেতেন। অপেক্ষায় থাকতাম আবার কবে বাবা ফিরে আসবেন উড়োজাহাজে চড়ে। অপেক্ষায় থাকতাম বাবা কখন ফোন করবেন। আর বাবার ফোন এলেই সবার আগে দৌড়ে গিয়ে বাবার ফোন ধরতাম। আজও বাবার ফোনের অপেক্ষায় থাকি। এই বুঝি বাবা ফোন করে বলবেন, ‘মা, তুমি কেমন আছো?’ বাবার মুখে ‘মা’ ডাকটি শোনার অপেক্ষায় থাকি। বাবা যখন মা বলে ডাকেন সেই মুহূর্তের অনুভূতি ও আনন্দ কখনও ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমার বাবা বেঁচে থাকুক ও ভালো থাকুক হাজার কোটি বছর।
স্বপ্ন দেখতে আমি ভয় পেলেও বাবা ভয় পেতেন না
বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন অ্যামাজনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও শি থিঙ্কস কোডের প্রতিষ্ঠাতা অনামিকা আহম্মেদ-
আমার বাবা আমাকে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার দিয়েছেন : তিনি আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। বাবা সব সময় আমাকে বলতেন যে আমি সাধারণ নই, আমি বিশেষ এবং আমি আমার যেকোনো স্বপ্নকে সত্যি করার শক্তি রাখি। কোনো বড় স্বপ্ন দেখতে আমি ভয় পেলেও আমার বাবা ভয় পেতেন না এবং আমার প্রতি তার বিশ্বাস আর উৎসাহের জন্যই হয়তো আমি আজকে বিশ্বের সেরা টেক জায়ান্ট অ্যামাজনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় স্কলারশিপ নিয়ে পারি জমানোটাও আমার স্বপ্ন কম, আমার বাবার স্বপ্ন ছিল বেশি। বাবা আমাকে সব সময় সামাজিক কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভালো থাকতে শিখিয়েছেন। সেই শিক্ষা থেকেই নারী ক্ষমতায়নে আমি বেশকিছু কাজ করেছি- যেগুলো দেশে এবং বিদেশে খুব ভালো সাড়া ফেলেছে। আমার সব সফলতার পেছনের সুপার হিরো এই মানুষটি। ধন্যবাদ বাবা, সব সময় আমার পাশে থাকার জন্য, আমাকে নিজের মতো করে গড়ে ওঠার স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা হওয়ার জন্য।
আমার সব অর্জনের নীরব কারিগর
বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া ‘বাপকা বেটা’ ব্যান্ডের ফাউন্ডার শুভাশিস ভৌমিক
বাবার সঙ্গে ছোটবেলার দুটি স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। প্রথমটি হলো, বাবা খুব ভোরে মশারির কোনা খুলে দিয়ে আমার ঘুম ভেঙে দিতেন। সারাজীবন তাকে দেখে আসছি ভোর ৫টার আগে ঘুম থেকে উঠতে এবং পরের দিনের সবকিছু আগের রাত ১০টার মধ্যে ঠিক করে ঘুমিয়ে পড়তে। তার এই অভ্যাসটি তিনি আমার মধ্যে এমনভাবে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন যে আমি এই অভ্যাস থেকে আর বের হতে পারিনি। যদিও পরবর্তী জীবনে আমার এই অভ্যাস সব সময়ই আমাকে সহায়তাই করেছে এবং কর্মজীবনে আমি প্রশংসিত হয়েছি।
আর দ্বিতীয়টি হলো, তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে প্রতিটি কাজ গুছিয়ে, গুরুত্ব দিয়ে করতে হয়। আমার প্রতিটি পরীক্ষার আগে তিনি আমার থেকে বেশি প্রস্তুতি নিতেন। পরীক্ষার আগের রাতে তিনি আমার পেনসিল-বক্সে নতুন কলম, পেনসিল, ইরেজার, স্কেল গুছিয়ে আমার জামা-প্যান্টগুলো আয়রন করে রেডি করে রাখতেন। এই বিষয়টিও আমাকে পরবর্তী জীবনে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করত যেকোনো কাজ করার আগে সবকিছু গুছিয়ে, ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে করার ক্ষেত্রে।
আমার কর্মজীবনে আজ যতটুকুই অর্জন তার পেছনের নীরব কারিগর তিনি। আমার কোনো কাজে তিনি বাধা দিতেন না। তিনি আমার মধ্যে এমন কিছু মূল্যবোধ ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, কেন যেন মনে হয় তিনি আমার পাশে ছায়া হয়ে আছেন। আমার কোনো ভুল কাজে তিনি কষ্ট পাবেন। ছোটবেলা থেকেই আমার সব সময় প্রচেষ্টা থাকে, কীভাবে আমার কাজগুলো দিয়ে আমি তার মুখে হাসি ফোটাতে পারব। এখন যখন তিনি আমার বা আমার সন্তানের বিভিন্ন অর্জন তার বন্ধু-বান্ধব সবাইকে শেয়ার করেন, তখন মনে হয় তাকে খুশি করার জন্য আমার ছোটবেলা থেকে প্রচেষ্টাগুলো বৃথা যায়নি। কারণ তার খুশির মধ্যেই আমার খুশি।
সে দিনটি ছিল স্মরণীয়
বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিফাত রাব্বানী
১৪ নভেম্বর আমার জন্মদিন। ২০০৭ সালের ওই দিনে আমার বায়না ছিল খেলনা উপহার লাগবে। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। আম্মু সকালবেলাই ভালো জামা-কাপড় পরিয়ে পরিপাটি করে দিলেন। তখন পঞ্চম শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষা চলছে। আব্বুর ডিউটি আছে, যেতে হবে কেন্দ্রে। আমিও পিছু নিলাম আব্বুর সঙ্গে যাব আর বাজার থেকে খেলনা আনব। অল্প বয়সি আমি খুশিতে আটখানা। আব্বুর পরীক্ষার ডিউটি শেষ হতে হতে ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকাল। এদিকে আবহাওয়া প্রতিকূল তা বোঝা যাচ্ছিল, কে জানে দিবাগত রাতেই আঘাত হানবে সিডর। আকাশ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আব্বু নিয়ে গেলেন বাজারে। অনেক দোকান ঘোরার পর, অনেকগুলো খেলনার মধ্যে একটা ইলেকট্রনিক হাতি পছন্দ হলো- যেটা হাঁটতে পারে। তখনকার সময়ে প্রায় ৫শ টাকায় কেনা হলো সেটি। এরপর বাড়ির পথ ধরতেই একটি ব্রিজ পার হব- দেখি আকাশ পুরো লাল, তখনও আমার মন বেজায় খুশি। কারণ মনের মতো খেলনা পেয়েছি। ওই সময় কত দ্রুত বাড়ি যাব এটা মাথায় ছিল না, ছিল খেলনার প্রতি লক্ষ্য।
আমার ওই আনন্দের সময়ে আব্বুকেও হাসিমুখে আমার সঙ্গে তাল মেলাতে দেখেছি। বাড়ি ফিরেও একই কাজ আমার- খেলনা নিয়ে পড়ে থাকা, মৃদু বৃষ্টি ও ঝড়-হাওয়ার মাঝেও আব্বু আর আমি সেই খেলনা নিয়ে ব্যস্ত। সারারাত তীব্র ঝড়, বাড়ির উঠান একগাদা গাছের পাতায় ভরপুর, সবাই কাজে ব্যস্ত, আব্বুও সঙ্গে। কিন্তু আমি নতুন খেলনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, আব্বুও বারবারই খেয়াল নিচ্ছে আমি কতটা খুশি আছি। এটি আমার একটি অন্যরকম স্মৃতি আব্বুর সঙ্গে। এখন বড় হয়ে বুঝছি বাবারা সন্তানের জন্য কতটা উদার, যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা সন্তানকে খুশি রাখেন। আব্বু, আমিও তোমার সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে চাই।