মৃত্যুঞ্জয় রায়
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৩ ১২:২১ পিএম
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৩ ১২:২২ পিএম
মধ্য জ্যৈষ্ঠের দুপুরবেলা। কাঠফাটা রোদে মাটির বুক ফেটে যাচ্ছে, নির্জীব ঘাসের বুকের ফাঁক দিয়ে উড়ছে ধুলো, পাকা চওড়া রাস্তাটাও যেন অচেনাÑ ফাঁকা, সুনসান। মানুষ কম, গাড়ি বেশি। পাকা রাস্তার ওপর বোধহয় ডিম ভেঙে ছেড়ে দিলে ওমলেট হয়ে যাবে! রাস্তায় রিকশাও যেতে চাইছে না। একটা কচি জারুল গাছের নিচে বসে দরদর করে ঘাম ঝরাচ্ছে কয়েকজন রিকশাওয়ালা। গনগনে সূর্যের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে মেঘের ছায়া চাইছে। কিন্তু কোথায় মেঘ? কোথায় বৃষ্টি? সব যেন আরবের মাঠ হয়ে গেছে। কাকপক্ষীও চোখে পড়ে না। আহা! এ সময় যদি রাস্তার দুই ধারে বড় বড় গাছের ছায়া থাকত, পথিক আর রিকশাওয়ালাদের কি শান্তিই না হতো! অগত্যা আগারগাঁও সিগন্যাল থেকে হেঁটেই চলে গেলাম বৃক্ষমেলার তোরণে।
রৌদ্রতপ্ত দুপুরে পিচঢালা পথে একদণ্ড শান্তি না পেলেও বৃক্ষমেলায় ঢুকে দুই দণ্ডের বেশি শান্তি পেলাম। কিছুদিন আগে যে মাঠটা ছিল ফাঁকা, সে জায়গাটা কি অসাধারণ করে সাজানো হয়েছে বৃক্ষমেলায় আসা গাছ-পসারীদের দিয়ে। এই গরমের মধ্যেও যেন এক টুকরো সবুজ শান্তি!
বৃক্ষমেলায় ঢুকেই পেলাম কন্ট্রোল রুম। সেখানে বসে থাকা মো. নজরুল ইসলাম জানালেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রতি বছরের মতো এবারও বৃক্ষমেলার আয়োজন করেছে। এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে ৭৩টি বেসরকারি নার্সারিসহ ৮৩টি স্টল। সেখানে থাকা সহকারী বন সংরক্ষক ব্রজগোপাল রাজবংশী বললেন, ‘বৃক্ষমেলা এক চমৎকার বেড়ানোর জায়গা। তবে এটা শুধু বিনোদনের জায়গা নয়। আমি অনেক মা-বাবাকে দেখেছি তাঁরা তাঁদের সন্তানদের এখানে নিয়ে আসেন গাছ চেনাতে, কোন ফলের গাছটা কেমন, কোন ফলের নাম কী, কোন ফুল কখন ফোটে, কোন গাছের কী গুণ ইত্যাদি জানাতে। এসব গাছ দেখতে দেখতে আর বৃক্ষমেলায় ঘুরতে ঘুরতে সন্তানদের মধ্যে গাছের প্রতি এক ধরনের মমতা ও আগ্রহ তৈরি হয়। এটাই কিন্তু বৃক্ষমেলার দীর্ঘস্থায়ী সুফল।’ বরিশাল নার্সারির মো. ইব্রাহিম বললেন, ‘এটা একদম সত্যি। শুধু মা-বাবা নন, আমি মনে করি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও ছাত্রছাত্রীদের এই জীবন্ত গাছের প্রকৃতির মেলায় নিয়ে আসা উচিত। ছাত্রছাত্রীরা এসে গাছপালা দেখুক, চিনুক, শেষে আগ্রহী হয়ে গাছ লাগাক। তা হলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে আমাদের পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে।’ ডিসি নার্সারির দীপক কুমার নাথ বলেন, ‘বৃক্ষমেলা শুধু টাকা উপার্জনের জায়গা না, সেবারও, সাধারণ মানুষকে প্রকৃতিমুখী করার এক চমৎকার আয়োজন।’ বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘সারা দেশে আমরা ২ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। ইতোমধ্যে প্রায় ১৩ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। যিনি নিজের জমিতে কমপক্ষে ১০টি গাছ লাগাবেন, তাকে গাছপ্রতি প্রকল্প থেকে ৪০ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হবে।’
প্রতিটি নার্সারির সামনে গাছপালায় ঠাসা, সবই পরিপাটি করে সাজানো যেন পার্কের কোনো রাস্তার দুই ধারে কেয়ারি করে লাগানো নন্দনতরু। শত শত রকমের গাছ। এবারের বৃক্ষমেলায় এ পর্যন্ত আসা উল্লেখযোগ্য কিছু গাছ হলো বিভিন্ন জাতের রঙিন আম, বছরের সব সময় ধরা আম, রঙিন আঁশফল, রাম্বুটান, বারোমাসি কাঁঠাল, সাদা জাম, মিষ্টি তেঁতুল, লাল কাঁঠাল, কাউ, থাই শরিফা, থাই সফেদা, সুগন্ধি জুঁই, ম্যান্ডেভিলা, ফার্স্ট লাভ, অলকানন্দা, কুরচি, করচ, মহুয়া, বৈলাম, ফ্রাঞ্জিপানি, লাল ফুরুস, আমাজান লিলি, ব্যারেল ক্যাকটাস, অর্কিড, অ্যাগ্লাওনিমা, অ্যানথুরিয়াম, লাল সোনালু ইত্যাদি।
এক মাস ধরে চলবে বৃক্ষমেলা। আমরা কি এই এক মাসে অন্তত একটি চারা ওখান থেকে কিনে নিজেদের বাগানে লাগাতে পারি না? কিংবা কোনো বন্ধুকে অন্তত একটি গাছের চারা উপহার দিতে পারি না? একদিন না খেলেও আমরা বাঁচতে পারি, কিন্তু এক মিনিট অক্সিজেন না হলে আমাদের চলবে না। সেই অক্সিজেনের মূল জোগানদাতা গাছ। আমরা যদি বাঁচতে চাই তাহলে গাছেদেরও আমাদের বাঁচাতে হবে।