গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৩ ১৪:১৫ পিএম
আপডেট : ১২ জুন ২০২৩ ১৪:১৬ পিএম
দারিদ্র্যের কুঠারাঘাত থেকে শিশুদের মুক্ত করতে না পারলে কমবে না শিশুশ্রম ছবি: ইন্দ্রজিৎ কুমার ঘোষ
যে হাতে বই থাকার কথা, জীবনের তাগিদে সেই হাতেই ভারী সরঞ্জাম তুলে নিচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতিমালা ও বাস্তবায়ন। আজ ১২ জুন, বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এ উপলক্ষে বিশেষ লেখা।
রোজ সকাল ৯টায় এসে বাইকের ওয়ার্কশপ খোলে ১২ বছর বয়সি কালাম। খুব সকালে এসে ওয়ার্কশপ খুলতে হয়, তা না হলে দিনের হাজিরা কাটা যাবে। এ চিন্তায় কালামও তাই আসতে দেরি করে না। ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা গেল ধ্যানমগ্ন হয়ে কালিমাখা জামায় বাইক মেরামতের কাজ করছে কালাম। প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরিয়েই দেশের এমন লাখো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ‘কাম না করলে খামু কী? বাপ নাই। মায়ে কাম করে অন্যের বাড়িত।’ কালামের উত্তরে জড়িয়ে আছে যেন লক্ষ্য শিশুশ্রমিকের ক্ষোভ, হতাশা আর অভিমান।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় রমজান আলীর (১৩) মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর গ্রামে নানির সঙ্গে তাকে রেখে মা চলে যান ঢাকায়। কাজ করেন একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। সেখানে নতুন সংসার পেতেছেন তিনি। বাবাও বিয়ে করেছেন। তবে কোথায় থাকেন, তা জানে না কিশোর রমজান আলী। নানিও পেশায় গৃহকর্মী। যে কারণে ঠিকমতো ভাত জোটাতে পারেন না। নাতিকে তাই ঢাকায় একই গ্রামের রহমতুল্লাহর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে কাজে দিয়েছেন দুই বছর হলো। সেখানে দিনে ১০০ টাকা বেতন পায় রমজান। সঙ্গে একবেলা খাবার জোটে। রমজান বলল, ইচ্ছে থাকলেও আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি তার। বিকাল হলে খুব খেলতে ইচ্ছে করে, বৃষ্টি নামলে ভিজে গোসল করতে ইচ্ছে হয়। তবে এই কিশোরের সব ইচ্ছাই চাপা পড়েছে কাজের চাপে। রমজান আলীর মতো অনেক শিশুশ্রমিক নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করছে।
বাড়ছে সংখ্যা প্রতিনিয়ত
বর্তমানে দেশে কী পরিমাণ শিশু কাজ করছে, বয়স বিবেচনায় তাদের কত অংশের কাজ অনুমোদনযোগ্য এবং অনুমোদনহীন শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কতÑ তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, দেশে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত তা নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘদিন কোনো জরিপ হয়নি। ফলে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত- সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। ২০১৩ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল। তবে করোনাকালে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক সময়ের ইউনিসেফের তথ্যানুসারেÑ বিশ্বব্যাপী শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১৬ কোটি শিশু। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের ৬.৮ শতাংশ শ্রমে নিয়োজিত।
শিশুশ্রমে কেন যুক্ত হচ্ছে শিশুরা বা কেনই-বা পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুশ্রমকে বাধা দিচ্ছে না অথবা নিরুৎসাহিত করছে না? এর অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্য।
ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’- ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি ৭ হাজার ২০০ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এই শিশুদের বেশিরভাগই ছেলে (৮২ শতাংশ) এবং তাদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কি না তা তাদের জানা নেই।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় শিশুশ্রমের প্রকোপ বেশি। এই জেলার মোট জনসংখ্যার ১৯.২ শতাংশ শিশুশ্রমে জড়িত। এ ছাড়াও বরগুনা জেলায় ১৫ শতাংশ, দিনাজপুর জেলায় ১৩.৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১১.৫ এবং পাবনা জেলায় ১১.২ শতাংশ শিশুশ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কর্মরত রয়েছে।
জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ, ভিক্ষাবৃত্তি বা চায়ের দোকানে, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে বাধ্য হওয়া এসব শিশু প্রতিদিন আঘাত ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ শিশু কাজ করার সময় আহত হওয়ার কথা জানায়। আর অর্ধেক শিশু জানায় সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা। কর্মরত শিশুদের প্রায় অর্ধেকই ৯ বছর বয়স থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব শিশুর বেশির ভাগই সপ্তাহে এক হাজার টাকা বা ১০ ডলারের কম অর্থের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে। শিশুশ্রম বন্ধের একমাত্র উপায় হলো দারিদ্র্য নিরসন। তবে যেকোনো দেশের দরিদ্র অবস্থা সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণের আগ পর্যন্ত শিশুশ্রম বন্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন।
সমাধান কোথায়?
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত এক লাখ শিশুশ্রমিককে উপানুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম আমরা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছি। ইতোমধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৫ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কর্মরত শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৮০০ জন হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ আটটি খাতকে ‘শিশুশ্রম মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুদের জন্য কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শিশুকক্ষ স্থাপন কার্যক্রম আগের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত থাকবে।'
দেশে শিশুশ্রম দূরীকরণে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। গত ১৬ মে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে শিশুশ্রম নির্মূলে ২০২১-২০২৫ জাতীয় কর্মপরিকল্পনার অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক কর্মশালায় জানানো হয়Ñ বিশ্বব্যাপী শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১৬ কোটি শিশু। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের ৬.৮ শতাংশ শ্রমে নিয়োজিত। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শিশুশ্রম নির্মূলের জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বা ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন (এনপিএ) গ্রহণ করা হয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনায় বর্ণিত পাঁচটি মূল কৌশলগত উদ্দেশ্য হলো :
১. শিশুশ্রমের প্রতি আগ্রহ কমানো
২. বিপজ্জনক ও মন্দ কাজ থেকে শিশুদের প্রত্যাহার করা
৩. কর্মক্ষেত্রে শিশুদের সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি
৪. অংশীদারত্ব ও একাধিক খাতের সম্পৃক্ততা
৫. এনপিএর যথাযথ বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন।
শিশুর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করা দ্য চয়েজ টু চেঞ্জ ফাউন্ডেশনের (সিটুসি) বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর মো. ফারহান শাহরিয়ার বলেন, দারিদ্র্য শিশুশ্রম প্রতিরোধের বড় বাধা। এ বাধা পেরোতে সবার যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বস্তিতে বসবাসরত ১২ বছরের নিচে প্রায় ৪২%-এর মতো শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ ও রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন এবং সফল করতে প্রতিটি বস্তিতে সিটুসির মতো মডেল প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে।
কী বলছে আইন
বাংলাদেশ শ্রমআইন ২০০৬-এ শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরদের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সিদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার চুক্তি করতে পারবে না। কিশোর শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কাজে নিয়োগ করতে হলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ নিতে হবে, যার খরচ বহন করতে হবে মালিককে। কিশোর শ্রমিকদের স্বাভাবিক কাজের সময় হবে ৫ ঘণ্টা। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে, ১২ বছর বয়সি শিশুদের দিয়ে সেই কাজগুলো করানো যাবে, যেগুলো তাদের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করবে না এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকার বিঘ্নিত করবে না।
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুশ্রম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই সনদে বলা হয়েছে, স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে সদস্য রাষ্ট্রগুলো শিশুশ্রমের জন্য বয়স, বিশেষ কর্মঘণ্টা ও নিয়োগে যথার্থ শর্তাবলি নির্ধারণ করবে। এ ছাড়াও শিশুর সুরক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অঙ্গীকার করা হয়েছে- যা পরোক্ষভাবে শিশুশ্রম নিরসনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ এই সনদে ১৯৯০ সালে স্বাক্ষর করেছে।
এত এত আইন ও পরিকল্পনার পরও কী কমেছে শিশুশ্রম? দারিদ্র্যের কুঠারাঘাত থেকে শিশুদের মুক্ত করতে না পারলে কমবে না শিশুশ্রম। কোমলমতি শিশুদের স্থান রেললাইনের পাশে কিংবা অন্ধকার সিঁড়িতে যেন না হয়। প্রতিটি শিশুর জীবন হোক প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। আমরা চাই, শিশুর আনন্দ মেলায় স্বর্গ নেমে আসুক।