× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হিমালয়ের পথে পথে

রাজীব চৌধুরী

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৩ ১৫:৪২ পিএম

আপডেট : ১০ জুন ২০২৩ ১৫:৪৬ পিএম

পর্বত ঘেঁষা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্বাদু পানির গোকিও লেক           ছবি : লেখক

পর্বত ঘেঁষা পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্বাদু পানির গোকিও লেক ছবি : লেখক

হিমালয়ের পথে পথে

গোকিও হয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সেই ক্ল্যাসিক রুট, যে পথ ধরে ১৯৫০-এর দশকে অভিযাত্রীরা এভারেস্ট আরোহণের জন্য ব্যবহার করে ছিলেন। লিখেছেন রাজীব চৌধুরী

মাউন্ট এভারেস্ট পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া। চূড়ায় ওঠা নয়, অন্তত কাছ থেকে এই পর্বত চূড়াকে দেখার ইচ্ছা সব পর্বতপ্রেমীদের থাকে। এ অঞ্চলে বাস করা শেরপাদের জীবনকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাটুকু এই অভিযাত্রার সবচেয়ে বড় পাওয়া। গোকিও হয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সেই ক্ল্যাসিক রুট, যে পথ ধরে ১৯৫০-এর দশকে অভিযাত্রীরা এভারেস্ট আরোহণের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। ট্রেক শেষ হয় লকুলায়। সেখান থেকে ফ্লাই করে চলে আসা কাঠমান্ডুতে। 

দুই হাজার মিটার উচ্চতায় নোনথালা গ্রাম

থামেল থেকে খুব ভোরে রওনা দিয়ে আজ আমরা প্রথম পৌঁছলাম নোনথালা গ্রামে। তখন সন্ধ্যা। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথে সারা দিনের জিপ জার্নি শেষে কিছুটা ক্লান্ত ভর করে। দুই হাজার মিটার উচ্চতায় নোনথালা গ্রামটি পরিপাটি পরিচ্ছন্ন সুন্দর৷ এই প্রথম ঠান্ডা অনুভব করা শুরু করলাম। আসার সময় আঁকাবাঁকা সোনকো শি নদী ছিল সঙ্গী। সর্বশেষ বিরতি ফাপলু গ্রাম। এখানকার রাস্তার পাশে একেকটা ঘর-দোকান খুব পরিচ্ছন্ন ও বাহারি রঙের ফুলগাছ দিয়ে সাজানো। চায়ের আড্ডা শেষে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে নোনথালা গ্রামে পৌঁছালাম আমরা। 

পরের দিন প্রথমেই পৌঁছে গেলাম কারি লা। যেখান থেকে আমাদের ট্রেক শুরু৷ সূর্যের কড়া রোদ ঘাম ঝরাচ্ছিল। মুগ্ধতা ছড়ানো পাইয়া গ্রাম, সুড়কি গ্রামে টি ব্রেক, সেফুলং গ্রামে লাঞ্চ করে ফাকডিংয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে আবার সন্ধ্যা হলো। পথের পাশে ফাংডিং লজ। দুই পাশেই পাহাড় পরিবেষ্টিত। লজটায় রাত কাটিয়ে দারুণ লেগেছে। 

পরের দিন রওনা দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আমরা টকটকে থামি। ট্রেক পারমিট নিতে হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার ন্যাশনাল পার্কের পারমিট নিতে হলো। সবাই হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে সবাই যেন পায়ে একটা ছন্দ খুঁজে পেয়েছে। কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর হিলারি ব্রিজ থেকে ওপরের দিকে উঠতে থাকি। পুলিশ চেকপোস্ট কার্ড দেখে এন্ট্রি করল। দিনের ঝলমলে আলো তখন আর নেই। শেষ বিকেলে আকাশের মন খারাপ। 

পর্বতঘেরা গ্রাম নামচে

নামচেতে আসামাত্র বৃষ্টি, স্নোফল পড়তে শুরু করেছে। লাল-নীল-সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে। বাতির আলোয় আর স্নো ফলের অবিরাম বর্ষণে গ্রামের ঘরগুলো অন্যরকম অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডারও প্রকোপ বেশ। পূর্ব নির্ধারিত নির্ভানা লজে ঢুকেই সোজা ডাইনিংয়ে গেলাম। এক কাপ জিনজার লেমন টি ছাড়া আর বিকল্প কিছু ছিল না। ছবির মতো সুন্দর পর্বতঘেরা গ্রাম নামচে। প্রকৃতি এখানে এমনই যে একেক মুহূর্তে একেক সৌন্দর্য ধরা দেবে। শেরপাদের রাজধানী খ্যাত এটাই সেই বিখ্যাত নামচে বাজার। আশপাশে হাইকিং করার অনেক রাস্তা আছে। সামনের দিনগুলোর জন্য উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আদর্শ জায়গা। ১১ হাজার ২৮০ ফুট উচ্চতার এই বাজার এক কথায় ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য। 

গোকিও রি (৫৩৫৭ মিটার) যেখান থেকে পৃথিবীর ৩টি উঁচু পর্বত দেখা যায়

গন্তব্য ডোলে গ্রাম

নামচে বাজার দুইরাত থেকে পরের দিন আমাদের গন্তব্য ডোলে গ্রাম। স্নো ফল শুরু হয়ে গেছে। লজে আমরা ছাড়া এই দিন আর কোনো পরিব্রাজক ছিল না। রাতে ভালো ঘুম হলো। সুন্দর, শুভ্রময় শান্ত এক সকাল আজ। ডোলের চার পাশ সবকিছু বরফ আচ্ছাদিত। আমরা এদিন যথারীতি ট্রেক করে পৌঁছে যাই মাছার মো। ওই দিনও স্নো ফল ছিল। মাছার মো চার হাজার ৪৭০ মিটার। মাছার মো থেকে আজ সকালে যখন ঘুম ভাঙল আবহাওয়া তখন পরিষ্কার। রাতে মাইনাস ৮ থেকে ৩-এ উন্নতি হলো। সকালের নাশতা শেষ করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্নো ফল আবার শুরু হওয়ায় মনে হচ্ছে কোনো এক সাদা বরফের দেশ পাড়ি দিচ্ছি। আজকের গন্তব্য গোকিও লেক। সূর্যের দেখা নেই। খুবই ধীরে ধীরে আমাদের হাঁটতে হচ্ছে। পথে কোন টি লজ ছিল না৷ এদিন পথে বিরতি বলতে মাঝেমধ্যে পাথরে বসে বিশ্রাম নেওয়া। একদিকে স্নো ফল আরেক দিকে জমে থাকা বরফের স্তূপের ওপর হাঁটা বেশ কষ্টসাধ্য। দুপুরের মধ্যে গোকিও লেক পৌঁছলাম। স্বচ্ছ নীল পানির লেককে ধূসর দেখাচ্ছে। ঠান্ডায় হিম হয়ে আছি। ট্রেক ছিল চার ঘণ্টার। 

গোকিও লেকের রোমাঞ্চ 

দারুণ রোমাঞ্চকর গোকিও লেকের আকর্ষণীয় চূড়া গোকিও রি (পাঁচ হাজার ৩৫৭ মিটার)। গোকিও লেক থেকে ৫০০ মিটার ক্লাইম্ব করতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ায় দেখব সূর্যোদয়। ইতোমধ্যে দুই দিন হয়ে গেছে গোকিওতে। দ্বিতীয় দিনের শেষরাত। আলো ফোটার আগের রাত ৩টায় আমরা যাত্রা করলাম। আবহাওয়া ভালো থাকলে আমাদের জন্য অপার্থিব আনন্দ সৌন্দর্য বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমরা ক্লাইম্ব করছি। ধীরে ধীরে চারদিক ফর্সা হতে শুরু করল। মনের শঙ্কা দূর হলো। আকাশ পরিষ্কার। মাউন্ট এভারেস্ট, লুৎসে ও মাকালু। ৩টাই সর্বোচ্চ পিক অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। ধীরে ধীরে পরিবেশ পরিষ্কার হতে থাকে। অদ্ভুত এক সুন্দরের অভ্যর্থনায় তাড়িত হলাম। ততক্ষণে সূর্যের আলো বেশ তেজ নিয়ে আবির্ভূত হলো। পর্বতের চূড়া সোনালি আভা ছড়াচ্ছিল। মিনিট ৩০ কাটিয়ে আমরা আবার নামতে শুরু করি। আজ আর থাকা হবে না গোকিওতে। নাশতা খেয়ে আমরা রওনা দিই থাগনাক গ্রামের উদ্দেশে। এখানে থেকে পরের দিন চোলা পাস অতিক্রম করতে হবে।

চোলা পাস হয়ে গ্লেসিয়ার অতিক্রম 

থাগনাক গ্রাম থেকে উৎফুল্ল চিত্তে শুরু করলাম দিনের হাঁটা। এই কদিন নানা অভিজ্ঞতা আর রোমাঞ্চকর দৃশ্য প্রাণিত করে রেখেছে। চোলা আসলে একটি সামিট পাস। পাঁচ হাজার ১২০ মিটার। ওপরে কড়া রোদের মধ্যে চোলা পাস অতিক্রম করতে হচ্ছে খুব সাবধানে। শ্বাস-প্রশ্বাসে বেশ কষ্ট হচ্ছে এখন। শেষ পর্যন্ত চোলা পাসের ফলকে দেখা পেলাম। এখানেই আমাদের বিরতি দেওয়া হলো। সঙ্গে করে নিয়ে আসা প্যাকেট লাঞ্চ শেষ করলাম। ততক্ষণে মানিয়ে নিয়েছি বেশ। নামতে শুরু করি আমরা। সামনে গ্লেসিয়ার। সবকিছুই আমাদের চমৎকার লাগছে। সূর্যের সঙ্গে মেঘের লুকোচুরিতে সুন্দর পর্বত আমাদাবলাম উঁকি দেয় আবার হারিয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা গ্লেসিয়ার অতিক্রম করে ফেলি। পৌঁছে যাই জংলায়।

আকাশে তখনও মেঘ জমেনি। আমরা রওনা দিই লবুচের উদ্দেশে। জংলায় দানবের মতো এক পর্বতের দেখা মেলে। চোল্লাচে পর্বত। বেশ সময় ধরে পথে সঙ্গী হয়ে থাকল। আবার পথে অনেক ট্রেকারদের লম্বা লাইনে মাঝেমধ্যে পড়তে হয়েছে। অর্থাৎ ট্রাফিক জ্যাম। লবুচে বেশ ব্যস্ত পাড়া। অগণিত ট্রেকারদের ভিড়। হেলিকপ্টার একটা আসছে আরেকটা যাচ্ছে। 

তাপমাত্রা যখন মাইনাস ১০ থেকে মাইনাস ১৬ 

লবুচেতে একরাত কাটিয়ে আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য গোরাকশেপ যাওয়া। গোরাকশেপ থেকে দুই ঘণ্টা ট্রেক করে বেসক্যাম্প পাঁচ হাজার ৩৬৪ মিটার যাই। অবশেষে চূড়ান্ত গন্তব্যে আমাদের পদচিহ্ন ফেলতে সক্ষম হই। আবহাওয়া খারাপ থাকায় বেসক্যাম্প থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সাদা বরফের সঙ্গে নীল বরফ। বিকেলের পর থেকে ঠান্ডা মাইনাস ১০-এ নামল। বেসক্যাম্প থেকে ফিরে এলাম আবার গোরাকশেপ। এপ্রিল থেকে জুন এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্বতপ্রেমীরা এদিকটায় বেশি আসেন। আবার অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। একদম মিনিট ধরেই আপনাকে চলতে হবে এখানে। রাতে থাকার জন্য লজে কোনো সিট খালি নেই। আমাদের থাকতে হয়েছে টেন্টে। রাতে তীব্র ঠান্ডা। সঙ্গে স্নো ফল পড়ছে। শেষরাতে তাপমাত্রা মাইনাস ১২ থেকে মাইনাস ১৬-তে নেমে এসেছে। 

এবার ফেরার পালা

গোরাকশেপে একরাত কাটিয়ে পরের দিন রওনা দিই সুমারি গ্রামের উদ্দেশে। পথে থুকলা পাসে থামলাম কিছুক্ষণের জন্য। অসংখ্য ফলক। বেদনার ভাষায় সেসব বীরদের নাম পড়লাম। স্মরণ করলাম, পর্বতে যারা হারিয়ে গেছেন। যাদের লাশ আর পাওয়া যায়নি। তাদের স্মরণে এই ফলকগুলো। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সজল খালেদের নামটা খোদাই করে লেখা। ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে ডেথ জোনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। রাতে থাকার জন্য সুমারি গ্রামে চলে আসি। পরের দিন সুমারি থেকে আট ঘণ্টার ট্রেক। নামচে বাজারে আবার ফেরা। পথে টেংগুচেতে মনেস্ট্রি দেখে নিলাম। নামচে থেকে প্রায় ২১ কিলো ট্রেক করে আমরা চলে এলাম লুকলা। প্রায় নয় হাজার ফুট উঁচুতে এ শহর মূলত বিমানবন্দরের জন্যই বিখ্যাত। আগের দিন খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমান ওড়েনি। আজ আবহাওয়া ভালো। সকাল থেকেই বিমান একটার পর একটা আসা-যাওয়া করতে লাগল। আমাদের ডাক পড়ে। ১৮ সিটের ছোট্ট বিমানে আমরা চড়ে বসলাম। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবনের মাটি স্পর্শ করার আগ পর্যন্ত একটা ভীতি কাজ করছিল।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা