রেজোয়ানের নৌকাস্কুল
হৈমন্তী শুক্লা
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩ ১৩:৪৩ পিএম
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৩৮ পিএম
তরুণ স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ানের নৌকাস্কুল মডেল দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের আটটি দেশে। যার মাধ্যমে বন্যাপ্রবণ এলাকার শিশুরাও পাচ্ছে সহজে শিক্ষার সুযোগ। সম্প্রতি বিশ্ব শিশু পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ রেজোয়ান।
দেশের বন্যাপ্রবণ এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে লড়ছেন স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ান। নদী-নালা, খাল-বিল পেরিয়ে স্কুলে যেতে পারে না দেশের অসংখ্য শিশু। ঝরে পড়ে অনেক সম্ভাবনা। এই শিশুদের জন্য ২০০২ সালে নিজের উদ্ভাবিত নৌকাস্কুল শুরু করেন তিনি। এই উদ্যোগে শিশুদের যেতে হয় না, বরং নৌকাস্কুল ছুটে যায় তাদের কাছে। বর্ষা ছাড়াও বছরজুড়েই এই সুবিধা পায় শিশুরা।
মোহাম্মদ রেজোয়ানের জন্ম নাটোরের চলনবিল এলাকায়, সিধুলাই গ্রামে। ছোট বেলায়ই দেখেছেন, নৌকার অভাবে কত রকম সংকটের মধ্য দিয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের। সেখান থেকেই শুরু স্বপ্ন বুনন। বলেন, ‘আমাদের ওই সময়টায় বাচ্চাদের স্কুলে যাওটা খুব কঠিন ছিল। সবার নৌকা ছিল না। গ্রামে একটি নৌকা থাকা ঢাকা শহরের গাড়ি থাকার মতো। আমার সব সময় মনে হয়েছে, এলাকার জন্য কিছু একটা করা উচিত। যখন আমি আর্কিটেকচার পড়লাম, তখন মনে হয়েছে এই জ্ঞানটা আমি কীভাবে এলাকার মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি। যেহেতু বন্যাকবলিত এলাকা, এখানে যদি কিছু তৈরি করি তা পানিতে চলে যাবে। এখানে স্টেশনারি বা বিল্ডিংয়ের মতো কিছুই করা যাবে না। তাহলে এখানে আসলে কী করা যেতে পারে। তখন আমার মনে হয়েছে, যেহেতু নৌকা ট্রান্সপোর্ট হিসেবে কাজ হয়, তাই এই অঞ্চলের মানুষের জন্য যেটা দরকার স্থানীয়ভাবে ইনোভেটিভ আইডিয়া। আমাদের যে ট্রাডিশনাল নলেজটা আছে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই যদি তৈরি করতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমরা একটা সাসটেইনেবল সলিউশন (টেকসই সমাধান) আমরা আনতে পারব। আসলে সেভাবেই নৌকা স্কুলের যাত্রা শুরু।’
শুরুতে একটা নৌকা দিয়ে নৌকাস্কুলের যাত্রা শুরু হয়। এখন সেখানে রয়েছে ২৬টি নৌকা। বিশেষভাবে ডিজাইন করা ভাসমান এই স্কুলটিতে রয়েছে সৌরচালিত বিদ্যুৎ। রয়েছে পাঠাগার, ল্যাপটপ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা। স্কুলটি চালু আছে নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে। নৌকাগুলোর ছাদ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় বানানো হয়েছে, যাতে মানুষ সহজেই এর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। দুই পাশে জানালা রয়েছে। প্রবল বর্ষার কথা চিন্তা করে এখানে মাল্টি লেয়ার ওয়াটার প্রুফ ছাদ ব্যবহার করা হয়েছে। দেশি নৌকার থেকে এই নৌকা অনেক বেশি প্রশস্ত। একসঙ্গে ৩০ জন শিক্ষার্থী এখানে অংশ নিতে পারে।
তবে শুরুটা খুব সহজ ছিল না। নৌকাস্কুল উদ্ভাবনের আগে ১৯৯৮ রেজোয়ান সালে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা’। মূলত এই সংস্থার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই নৌকাস্কুলের যাত্রা। শুরুতে মানুষের কাছে এই স্কুলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম মাসে একজন, একজন করে ৩০ জন শিক্ষার্থী আসে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তেইশশর বেশি। যখন নৌকাস্কুলের সুবিধাটা অভিভাবক ও শিশুরা বুঝতে পারল তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের আটটি দেশ রেজোয়ানের এই মডেল গ্রহণ করেছে।
চলতি বছর, বিশ্ব শিশু পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া তিনজনের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ রেজোয়ান। আগামী ৪ অক্টোবর সুইডেনে এবারের ২০তম বিশ্ব শিশু পুরস্কার প্রদান করা হবে। বিশ্বজুড়ে সংবাদ-মাধ্যমগুলোয় সুইডেনভিত্তিক এই পুরস্কারকে ‘ছোটদের নোবেল প্রাইজ’ আখ্যা দেওয়া হয়।
তিনি জানান, ‘সুইডেনভিত্তিক বিশ্ব শিশু পুরস্কার ফাউন্ডেশন “বিশ্ব শিশু পুরস্কার” দিয়ে থাকে। এটা প্রতিবছরই দিয়ে থাকে। ১০ বছরে যারা পেলেন তাদের মধ্যে আবার একজন নির্বাচন করা হয়। এবার ১২টি দেশের শিশুদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে চাইল্ড জুরি করা হয়, তাদের কাছে নমিনেশনগুলো দেওয়া হয়েছিল। তারা তিনজন ব্যক্তিকে ‘শিশু অধিকার নায়ক’ হিসেবে নির্বাচন করেছে।’
মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনি ছাড়াও রয়েছেন একজন কানাডার নাগরিক, অন্যজন ভিয়েতনামের নাগরিক। এখান থেকে ভোটে একজন নির্বাচিত হবেন। তাকে বলা হবে ‘বিশ্ব শিশু পুরস্কার ফর চাইল্ড রাইটস’। আর বাকি দুজন যারা কম ভোট পাবেন, তাদের বলা হবে ওয়ার্ল্ড চিলড্রেনস প্রাইজ অনারি অ্যাওয়ার্ড রিসিপিয়ান’। পুরস্কার বিতরণে সহযোগিতা করবেন সুইডেনের রানী সিলভিয়া।
মোহাম্মদ রেজোয়ান তার উদ্যোগের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যে পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অন্তত ১৬টি পুরস্কার। নৌকা স্কুলের ধারণা জাতিসংঘের ফান্ডস অ্যান্ড প্রোগ্রামস (ইউনিসেফ, ইউএনইপি এবং ইউএনডিপি) থেকে ইনোভেশন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের এক্সেস টু লার্নিং অ্যাওয়ার্ড, শাইনিং ওয়ার্ল্ড কম্প্যাশন অ্যাওয়ার্ডসহ (SHINING World Compassion Award.) অনেক স্বীকৃতি।
কয়েকটি দেশে শিশুদের পাঠ্য বইয়ে স্থান পেয়েছেন মোহাম্মদ রেজোয়ান ও তার উদ্ভাবিত নৌকাস্কুল ও সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার গল্প। ২০১৯ সালে ‘আর্থ হিরোজ’ নামের একটি গ্রন্থে রেজোয়ানকে বিশ্বের ২০ জন বিশ্বনেতার একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার ভাসমান স্কুলকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নৌকাস্কুলে শুধু পাঠদানই করা হয় না, সেই সঙ্গে স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের স্বনির্ভর করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
নৌকাস্কুল ও সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার কার্যক্রমের পরিধি একসময় দেশের সব জেলায়ই থাকবে বলে আশা করছেন স্থপতি মোহাম্মদ রেজোয়ান। দেশের মানুষ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছে। তাদের এই সংগ্রামী চরিত্র আমাকে শিশুদের জন্য ভাসমান স্কুল গড়তে অনুপ্রাণিত করেছে।
ছবি: আবির আব্দুল্লাহ