সুন্দর ঝলমলে চুল কে না চায়! তবে জ্যৈষ্ঠের গরমে ঘাম ও ধুলোবালির কারণে চুল হয়ে পড়ে নির্জীব। তাই খোলা নয়, চুল থাকুক বাঁধা। এতে স্টাইলের যেমন কমতি হবে না, তেমনি গরমেও মিলবে স্বস্তি। তবে এই সময়ে চুল সুন্দর রাখতে হলে প্রয়োজন একটু বাড়তি যত্নের
গরমের দিনে ঘামের জন্য অস্বস্তির শেষ থাকে না। তার ওপর যদি কাঁধে, ঘাড়ে এলোমেলো চুল এসে পড়ে, তবে বিড়ম্বনা যেন আরও বাড়ে! এ ছাড়া ধুলো-ময়লাও বেশি জমে। চুল খুলে রাখলে, রোদের তাপে রুক্ষ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই সবদিক ভেবে চুল বেঁধে রাখাই শ্রেয়। এতে চুল সামলাতেও সুবিধা হবে। তবে খুব টেনে বা টাইট করে বাঁধা উচিত নয়। কারণ এমনিতেই ঘামে চুলের গোড়া নরম হয়ে থাকে। উপরন্তু টান পড়লে চুল পড়া বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
চুল বাঁধতে চাইলে করতে পারেন নানা ধরনের বিনুনি ও পনিটেল। ফ্রেঞ্চ বেণি, ফিশটেল বেণি, লুপ পনিটেল, মেসি বান, ইনভার্টেড পনিটেল, সামুরাই বান প্রভৃতি হেয়ারস্টাইল ফ্যাশনপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায়। যদি চুল ছোট করতে চান, তবে এ-লাইন বব, ব্লাস্ট বব ও পিক্সি কাট দিতে পারেন। নানা রকমভাবে চুল তো কাটতেই পারেন। কিন্তু এই সময়ে একটু অন্যরকম হেয়ারস্টাইল করলে মন্দ হয় না! ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় চুল বাঁধার স্টাইল ছিল বেণি। সেই বেণিই এখন চুলের ফ্যাশনে বাজার দখল করে নিয়েছে। ঘরে কিংবা বাইরে, রেড কার্পেট থেকে ফ্যাশন শো- সর্বত্রই স্টাইলিস্টদের প্রথম পছন্দ বেণি।
গরমের স্টাইলিশ বেণি
চুলে বেণি করা যেমন চিরায়ত ফ্যাশন তেমনই এটি স্টাইলিশ। আবার এই গরমে বেণি আরামদায়কও বটে! পেছনে একটা ফ্রেঞ্চ বেণি না করে চাইলে দুই পাশে করতে পারেন। চুল দুই ভাগ করে উপর থেকে বেণি করে কানের পেছন পর্যন্ত এনে রিবন দিয়ে আটকে দিতে পারেন কিংবা নিচের দিকে পুরো চুলও বেণি করে নেওয়া যায়। প্রতিদিনের কুর্তি, ফতুয়া বা শার্টের সঙ্গে এই হেয়ারস্টাইল মানিয়ে যাবে খুব সহজে। একদিকে চুল নিয়েও করতে পারেন বেণি। উপর থেকে ফ্রেঞ্চ বেণি করে একপাশে চুল নিয়ে মেসি বেণি করতে পারেন। শাড়ি, কুর্তি সব পোশাকেই এই চুলের বাঁধন ট্রেন্ডি লুক দেবে। তবে এই হেয়ারস্টাইল করতে বেশ সময় লেগে যায়। যদি আপনার হাতে সময় কম থাকে তাহলে প্রথমেই মাথায় আসবে পনিটেইলের কথা। সেই চিরচেনা পনিটেইলেও আনতে পারেন টুইস্ট। এক পাশে অল্প চুল নিয়ে বেণি করে বাকি চুলের সঙ্গে উঁচু করে পনিটেইল বেঁধে নিন। এটি খুব স্বল্প সময়ে আপনাকে ভীন্ন লুক দেবে।
বেণি বাঁধার আগে
বেণি বাঁধার আগে ভালো করে চুল আঁচড়ে নিতে হবে। চুলে যাতে কোনো জট না থাকে। চুল আঁচড়ানোর সময় মোটা দাতের চিরুনি ব্যবহার করা উচিত, এতে চুল ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। চুল বাঁধার আগে হেয়ার স্টাইলিং প্রডাক্ট যেমন- হেয়ার সিরাম, হালকা কোনো তেল অথবা ওয়াটার বেসড জেল লাগিয়ে নিতে পারেন। এতে চুলের উজ্জ্বলতা বাড়বে। পাতলা চুলের জন্য অনেকে বেণি করতে পারেন না। চুল কম থাকলে বেণি দেখতে একটু খারাপই লাগে। কিন্তু এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বেণিতে মোটাভাব আনার জন্য বাঁধার আগে একটু ব্যাককোম্ব করে নেবেন। এ জন্য চুলের যে অংশ দিয়ে বেণি বাঁধবেন সেই অংশের গোড়ার দিকে ছোট দাতের চিরুনি দিয়ে চুল যেভাবে আঁচড়ান, তার উল্টো দিকে আঁচড়াবেন। এরপর উপরের দিকে চুলটা পেতে আলতো করে আঁচড়ে নেবেন। ফলে চুলে ভলিউম আসবে এবং চুল ফোলাও লাগবে।
যত্নে থাকুক চুল
শুধু বেণি করলেই তো হবে না, সঙ্গে চুল সুন্দর রাখতে যত্নও নিতে হবে। গরমে চুল বেঁধে রাখলে ধুলোবালি কম লাগবে, কিন্তু একেবারে যে না লাগবে তাও নয়। আর সঙ্গে ঘামে ভেজা স্ক্যাল্প থেকে নানা ধরনের সমস্যাও অবধারিত। একদিকে রুক্ষ, নির্জীব চুল, অন্যদিকে অতিরিক্ত তেলতেলে স্ক্যাল্প থেকে নানা সমস্যা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে চুলের সমস্যায় রীতিমতো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এসব সমস্যা এড়াতে এ সময় প্রয়োজন একটু বাড়তি যত্নের।
মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখুন
অনেকেই ভাবেন প্রতিদিন চুলে শ্যাম্পু করা উচিত নয়। শ্যাম্পুতে থাকা নানা ধরনের কেমিক্যাল চুল শুষ্ক করে দেয়, চুল রুক্ষ হয়ে যায় ইত্যাদি। এই ধারণা ঠিক নয়। বরং রোজ শ্যাম্পু না করলে সমস্যা আরও বাড়বে। প্রতিদিন বাইরে বের হলে রাস্তার ধোঁয়া, ধুলোবালি মাথার ত্বকে জমা হয়ে চুলের গোড়া বন্ধ করে দেয়। ফলে চুল বাড়তেও যেমন সমস্যা হয় তেমনি স্ক্যাল্পের নানা সমস্যাও দেখা দেয়। শুধু বাইরে বেরোলেই যে স্ক্যাল্পে ময়লা জমে তা নয়। বাড়িতে থাকলেও ঘাম জমে স্ক্যাল্পের ক্ষতি হতে পারে। তবে এটাও ঠিক, প্রতিদিন অতিরিক্ত কেমিক্যালযুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা ঠিক নয়। রোজ শ্যাম্পু করার ক্ষেত্রে মাইল্ড বা বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। সরাসরি শ্যাম্পু মাথায় না লাগিয়ে, পানিতে মিশিয়ে পাতলা করে নিন। এতে চুল রুক্ষ হবে না। রিঠা ভেজানো পানি দিয়েও চুল পরিষ্কার করতে পারেন। এতে চুল পড়া কমবে এবং নিয়মিত ব্যবহারে চুল হয়ে উঠবে ঘন।
হেয়ার কন্ডিশনিং
সময়ের অভাবে অনেক সময় শ্যাম্পু করার পর চুলে কন্ডিশনার লাগানো হয় না। এটি একদম ঠিক নয়। এতে চুল রুক্ষ হয়ে যায়। বিশেষত গরমকালে সূর্যের প্রখর রোদে চুলের স্বাভাবিক আর্দ্রতাও নষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রতিদিন শ্যাম্পুর পর চুলে অবশ্যই কন্ডিশনার লাগাতে হবে। চটজলদি কন্ডিশনিংয়ের ক্ষেত্রে কেমিক্যালযুক্ত কন্ডিশনারই ভরসা। তবে সপ্তাহে এক দিন বাড়িতে বানানো কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। শ্যাম্পু করার পর ভেজা চুলে দুই চামচ মধু এবং এক টেবিল চামচ নারকেল তেল একসঙ্গে মিশিয়ে পুরো চুলে লাগিয়ে রাখুন। আধঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলুন। অথবা অ্যাপেল সিডার ভিনিগারে চুল ধুয়ে নিতে পারেন। এতে রুক্ষতা দূর হবে, চুল হবে নরম।
রোদ থেকে সুরক্ষা
গরমে সূর্যের প্রখর রোদ থেকে চুলকে বাঁচানো খুব কঠিন। খুব বেশিক্ষণ স্কার্ফ বা টুপি পরে থাকলেও ঘামে ভিজে স্ক্যাল্পের নানা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আলাদা করে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। এখন অনেক ধরনের সিরাম বাজারে মেলে, যা ইউ-ভি প্রোটেকশন যুক্ত। সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
ঘরোয়া সিরাম
চাইলে নিজেই ঘরে বানিয়ে নিতে পারেন সিরাম। উপকরণ হিসেবে লাগবে পানি, অ্যালোভেরা জেল এবং অ্যাভোকাডো তেল। সমপরিমাণে তিনটি উপকরণ মিশিয়ে স্প্রে-বোতলে রাখুন। দরকার পড়লে চুলে স্প্রে করে নিন। চুল রোদ থেকে পাবে সুরক্ষা।
চুলকে গভীরভাবে পুষ্টি দিতে গরম তেল ম্যাসাজের কোনো বিকল্প হয় না। আর যেহেতু এই সময় প্রতিদিন শ্যাম্পু করা প্রয়োজন, তাই তেল না লাগালে চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। একদিন অন্তর, রাতে অথবা শ্যাম্পু করার এক ঘণ্টা আগে মাথায় তেল ম্যাসাজ করুন। তবে সপ্তাহে একদিন অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নারকেল, অ্যাভোকাডো, অলিভ, আমন্ড ইত্যাদি তেল খুব সহজেই চুলের গোড়ায় পুষ্টি জোগায়। তাই সব রকম তেল ব্যবহার করা উচিত। চাইলে একসঙ্গে মিশিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। অল্প গরম করে পুরো চুলে, মাথার ত্বকে ভালোভাবে লাগিয়ে নিন। এরপর গরম পানিতে তোয়ালে ডুবিয়ে, মাথায় জড়িয়ে রাখুন। আধঘণ্টা রেখে চুলে শ্যাম্পু করে নিন।
ঘরোয়া হেয়ার প্যাক
গরমকালে রোদ থেকে বাঁচতে চুলের প্রয়োজন বাড়তি যত্নের। তেলে লেবু, ক্যামোমাইল, ল্যাভেন্ডার, রোস্লামেরির মতো প্রাকৃতিক হার্ব মিশিয়ে, ফুটিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। ঘরোয়া এসব প্যাক রাতারাতি ফল না দিলেও কেমিক্যালযুক্ত সামগ্রী থেকে অনেক ভালো। সূর্যের বেগুনি রশ্মি থেকে চুলকে বাঁচাতে এই প্যাকগুলো বেশ উপকারি।
১/৪ কাপ মধু হালকা গরম করে সঙ্গে ১/৪ কাপ অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন। মিশ্রণ একটু ঠান্ডা হলে আঙুলের সাহায্যে পুরো চুল এবং স্ক্যাল্পে লাগান। এবার গরম পানিতে তোয়ালে ডুবিয়ে মাথায় জড়িয়ে রাখুন। আধঘণ্টা রেখে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। অলিভ অয়েলের পরিবর্তে নারকেল তেলও ব্যবহার করতে পারেন।
লেবুর রস, ২টি ডিমের কুসুম, একটা ডিমের সাদা অংশ এবং ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে চুলে লাগান। ১০-২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
গরমের জন্য দারুণ একটি হেয়ার প্যাক হলো টকদই এবং আমন্ড অয়েলের মিশ্রণ। টকদই খুশকি কমাবে, চুলকে নরমও করবে। আধাকাপ টকদই, ২ টেবিল চামচ আমন্ড অয়েল এবং এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে চুলে লাগান। ১-২ ঘণ্টা রেখে শ্যাম্পু করে নিন।
গরমকালে চুলের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে নির্জীব ও নিষ্প্রাণ চুল অন্যতম প্রধান। এ সমস্যা দূর করতে ১ কাপ নারকেল তেল, আধাকাপ লেবুর রস, ৩ টেবিল চামচ শুকনো জবাফুলের গুঁড়া একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। পুরো চুলে এই প্যাক লাগিয়ে ২৫-৩০ মিনিট রেখে মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। রুক্ষতাও থাকবে না, আর চুলও হয়ে উঠবে নরম, কোমল ও চকচকে।
টিপস :
রোদে বের হলে মাথায় স্কার্ফ, টুপি বা ছাতা ব্যবহার করুন। সুতির স্কার্ফ ব্যবহার করবেন। খুব টাইট কিছু মাথায় না লাগানোই ভালো।
রোদ থেকে চুল বাঁচাতে এসপিএফ-যুক্ত হেয়ার সিরাম ব্যবহার করুন।
ড্রায়ার বা স্ট্রেটনার ব্যবহার করবেন না। এতে চুল লালচে হয়ে যাবে। রুক্ষতাও বেড়ে যাবে। তবে একান্তই প্রয়োজন পড়লে একদম কম তাপমাত্রায় ব্যবহার করবেন। ব্লো-ড্রায়ারের হিট সেটিংসও একেবারে কমে রাখুন।
বড় দাতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান।
এই সময় ঘামের মাধ্যমে শরীরের অনেক পানি এবং মিনারেলস বেরিয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়াও প্রয়োজন। এতে চুল ভালো থাকবে।
চুল ভালো রাখতে ডায়েটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। টাটকা ফল, সবজি ও বাদাম প্রতিদিনের ডায়েটে রাখুন।