বেগম-এর নূরজাহান বেগম
মালেকা বানু
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩ ১৩:৩৩ পিএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৩ ১৩:৪০ পিএম
নূরজাহান বেগম [জন্ম : ৪ জুন ১৯২৫ - মৃত্যু : ২৩ মে ২০১৬]
বাংলাদেশের নারী জাগরণে নূরজাহান বেগম এবং তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকা অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। এক কথায় যদি বলি, সেটা সত্যিই অতুলনীয়। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নূরজাহান বেগমের বাবা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। কিন্তু দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন নূরজাহান বেগম।
যে সময় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই- একটা পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থা চলমান ছিল। যেখানে নারীকে শিক্ষিত হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। যেখানে নারী অধিকার বলে কিছুই ছিল না। নানাভাবে নারী বৈষম্যের শিকার হতো। এমন একটি সমাজে শুধু নারীর জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ সত্যিই অতুলনীয় এবং সাহসী পদক্ষেপ ছিল বলেই মনে করি।
বেগম নামের এই পত্রিকা নারীদের জন্য তো বটেই, এই পত্রিকার লেখকরাও ছিলেন নারী। নারীর সৃজনশীলতা প্রকাশে ও তাদের আধুনিক মননশীলতায় গড়ে তুলতে বেগম পত্রিকার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। আমরা দেখেছি সহস্রাধিক নারী লেখক এই পত্রিকায় লিখে নিজেদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে নিজ চেষ্টায় তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে রেখেছেন দারুণ অবদান।
যে সময় সমাজের মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারত না, ঘরের বাইরে যেতে পারত না, এমনকি কোথাও তাদের ছবিও প্রকাশ করা হতো না; সেই সময়ে মেয়েদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার যে প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছিলেন সেটা এক কথায় অনন্য এবং বাংলাদেশ তথা বাঙালি নারী জাগরণের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
১৯৪৭ সালে বেগম পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু আমরা যখন বেড়ে উঠেছি সেই ষাটের দশকে, তখনও এর প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। আমাদের বাসায় রাখা হতো বেগম। পরবর্তী সময়ে মনে হয়েছে, এই পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে আমাদের মা-খালারা আধুনিকমনস্ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আমাদের অভিভাবকদের মননশীলতায় বেগমের একটি সুদূরপ্রসারী ও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল, যা তারা আমাদের বড় করে তুলতে কাজে লাগিয়েছেন। তাই বলব, আমার তথা আমাদের আজকের যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তার পেছনে বেগম পত্রিকা এবং নূরজাহান বেগমের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে।
শৈশব থেকেই বেগমের নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। কখনও হয়তো লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পড়তাম। মেয়েদের জীবনকাহিনী, মেয়েদের লেখা গল্প-কবিতা, বিভিন্ন দেশের কথাসহ নানা স্বাদের নানা আঙ্গিকের কত রকমের যে লেখা থাকত বেগমে, যা আমার তো বটেই, আমাদের প্রজন্মের মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
বেগম পত্রিকা আমাদের বাসায় যেহেতু রাখা হতো, সেহেতু এই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আমার শৈশব থেকেই পরিচয় ছিল। যদিও মানুষটিকে সামনাসামনি তখনও দেখিনি। তাঁর কোনো এক জন্মদিনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে যাই। সেদিনই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, কথা হয়। সে সময়ও তাঁকে দেখেছি পত্রিকা নিয়েই ভাবতে। বেগমের নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় আমাদের। শেষের দিকে নূরজাহান বেগমকে তাঁর পত্রিকা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখেছি। তিনি তখন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছে বেগম প্রকাশের ধারাবাহিকতা নিয়ে সহায়তা চেয়েছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেছি আমরা। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে যে পত্রিকা তিনি সন্তানতুল্য মমতায় প্রকাশ করেছেন; যে কাজ থেকে নিজেকে ক্ষান্ত করার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না, সে পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের শেষ বয়সে তাঁর মধ্যে দেখেছি উদ্বেগ, আকুলতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেগম পত্রিকাকে ঘিরেই ছিল তাঁর চিন্তা-ভাবনা।
আমরা জানি, নূরজাহান বেগম তাঁর শৈশবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। সুফিয়া কামালের সান্নিধ্য পেয়েছেন দীর্ঘদিন। সওগাত পত্রিকার কল্যাণে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল কাজী নজরুল ইসলামসহ সে সময়কার জ্ঞানী-গুণী সাহিত্যিকদের। নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির আন্দোলনের পথে কাজের ক্ষেত্রে তার মানস গঠনে এই মানুষগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে একজন নারীর পক্ষে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে প্রয়োজন ছিল অতুলনীয় সাহসের। সেই সাহস তিনি দেখিয়েছেন, সেই চ্যালেঞ্জটি তিনি নিয়েছেন। এবং সে পথে তিনি সফলও হয়েছেন। আজকের দিনে সাংবাদিকতা পেশায় অনেক নারীই কর্মরত আছেন। কিন্তু নূরজাহান বেগম যখন এসেছিলেন সাংবাদিকতার জগতে তখনকার অবস্থা এবং আজকের অবস্থার মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল ফারাক। সাংবাদিকতায় তিনি শুধু আসেননি, ধারাবাহিকভাবে নিরলস কাজ করে গিয়েছেন এবং এই পেশায় আসার ক্ষেত্রে হাজার হাজার নারীকে পথ দেখিয়েছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
নূরজাহান বেগম যখন তাঁর এই কাজ শুরু করেছিলেন, তখন নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারীর প্রতি বৈষম্যের বিষয়গুলো সমাজে প্রোথিত ছিল। সেই জায়গা থেকে তার এই কাজের মাধ্যমে তিনি সফল হয়েছেন বলেই মনে করি। আজকের লেখালেখি এবং সাংবাদিকতার মূলধারায় সাফল্যের সঙ্গে যে নারীরা বিচরণ করছেন, তাতে নূরজাহান বেগমের রয়েছে অসামান্য অবদান।
নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আজীবন কাজ করে যাওয়া মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। শেষের দিনগুলোতেও তার ধ্যান-জ্ঞান আবর্তিত হয়েছে বেগম পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। তিনি ভাবতেন, তাঁর আরও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি আছে। কাজের ফলাফল ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে সমাজ তাকে কিছু ফিরিয়ে দেবে এমন কোনো ভাবনা কখনও তিনি ভাবেননি। ২৩ মে এই মহীয়সীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। নারী জাগরণের এই অগ্রদূতের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ