ঘুরতে আমরা কে না ভালোবাসি? যান্ত্রিক শহরের কোলাহল ভুলে কাছের মানুষদের নিয়ে প্রকৃতির নির্জন জায়গায় একান্তে সময় কাটাতে চায় সবাই। তবে প্রকৃতির দেখা পেতে বা মনোরম যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারাস অভিজ্ঞতা নিতে হলে বহু পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় গন্তব্যস্থলে। পাহাড়ে নতুন নতুন পথ বা ঝরনা খুঁজে বের করা, এগুলোর উৎস অনুসন্ধান করা, দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কোনো গন্তব্যে যাওয়া, প্রতিকূল পরিবেশে তাঁবু গেড়ে থাকা, নানা ধরনের দুঃসাহসিক বা একটু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ- যার মধ্যে একটা অভিযানে বের হওয়ার আনন্দ বা রোমাঞ্চ আছে- সেগুলো করার ব্যাপারেই বর্তমানের তরুণ পর্যটকদের আগ্রহ বেশি।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সম্প্রতি। ঢাকার বাইরে এ রকমের জায়গাগুলোতে ঘুরে আসতে হলে যাতায়াত খরচ ও সময় দুটিই ব্যয়বহুল। তাই বলে কি ঘুরতে যাওয়া হবে না? আজকের আলোচনায় ভ্রমণপিপাসু ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের জন্য থাকবে ঢাকার ভেতরে অবস্থিত এমনই একটি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পের বিস্তারিত তথ্য।
বাংলাদেশের প্রথম আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ‘দ্য বেস ক্যাম্প বাংলাদেশ’। এটি ঢাকার অদূরে গাজীপুরের সফিপুরে অবস্থিত। ২০১৩ সালে এ ক্যাম্প নিজেদের কার্যক্রম শুরু করেছিল এবং যাত্রা শুরুর পর থেকেই স্বল্প সময়ে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঘন সবুজ বর্ণমালা, নদী ও গাছগাছালির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অ্যাডভেঞ্চারাস কার্যক্রম পরিচালনা করায় মানুষের কাছে এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এ বেজ ক্যাম্পটি। গতানুগতিক ও একঘেয়েমি জীবন থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির মাঝে রোমাঞ্চকর কিছু মুহূর্ত অনুভব করতে ‘দ্য বেজ ক্যাম্প’কে রাখতে পারেন আপনার পছন্দের তালিকায়। বিভিন্ন ধরনের রোমাঞ্চকর ও আকর্ষণীয় অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রমের সুযোগ দিয়ে থাকে এ বেজ ক্যাম্পটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অ্যাডভেঞ্চারাস অনুভবের মেলবন্ধনে এ ক্যাম্পটি দিন দিন অ্যাডভেঞ্চারপিপাসু মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রিসোর্ট বলতেই আরাম-আয়েশে ছুটির দিন কাটানোর যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে গাজীপুরে অবস্থিত দ্য বেস ক্যাম্প তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নই বলতে গেলে। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে আগত অতিথিদের পার্ক করা গাড়ির সারি। সামনে লেপটে থাকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া খোলা মাঠ, তাতে কেউ ক্রিকেট খেলছে, কেউ তীর ছুড়ছে। আবার হয়তো দেখবেন দল বেঁধে হাঁস হেঁটে যাচ্ছে। শিশুদের কেউ বা ব্যস্ত বল ছোড়াছুড়িতে, কেউবা চালাচ্ছে সাইকেল।
ক্যাম্পের কার্যক্রমগুলো
বেস ক্যাম্পটি আপনি মূলত একই সঙ্গে বেশ কিছু অ্যাডভেঞ্চারাস কার্যক্রমের সুযোগ পেয়ে থাকবেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘অনগ্রাউন্ড’ ও ‘অনট্রি’ অ্যাক্টিভিটি। এ ছাড়া রয়েছে টিম বিল্ডিং, ট্রেজার হান্টসহ নানা ধরনের অ্যাক্টিভিটি। অনগ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটির মধ্যে রয়েছে ‘সাইক্লিং, মাঙ্কি পাস, টায়ার পাস, টায়ার স্যান্ডউইচ, জিপ লাইনিং, রোপ ট্রেঞ্চ, রোপ ওয়াক, বোটিং, ফুটবল, আর্চারি, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলার সুযোগ। গ্রুপ অ্যাক্টিভিটির ক্ষেত্রে দুটি দলে ভাগ করা হয় ভ্রমণকারীদের। এরপর দুটি দলের মধ্যে অ্যাক্টিভিটিগুলো পরিচালিত হয় ও অ্যাক্টিভিটির শেষে বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করা হয়। সব অ্যাক্টিভিটিতে যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করবে, তাকে বেস্ট ক্যাম্পার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া ও বাচ্চাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে স্পেশাল জোনের, যেখানে তারা খেলাধুলা ও অন্যান্য অ্যাক্টিভিটি উপভোগের সুযোগ পাবে। এর বাইরেও বেস ক্যাম্পে থাকছে সুইমিংপুল, ট্রি হাউস বা মাচাং ঘর, ট্র্যাকিং, ফিশিং ও টেন্টের সুবিধা। রাতের বেলা পরিবার-পরিজন অথবা বন্ধুদের সঙ্গে তাঁবুতে থাকার পাশাপাশি ক্যাম্প ফায়ার ও বার-বি-কিউ পার্টির আয়োজন করতে পারবেন আপনারা। অ্যাডভেঞ্চার থ্রিল উপভোগ করতে তাঁবুতে রাত কাটানোর বিষয়টি বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে থাকে ভ্রমণকারীদের জন্য। একটি বেস ক্যাম্পেই আপনি একই সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছেন এতগুলো অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাক্টিভিটি উপভোগের সুযোগ। ‘অন ট্রি’ অ্যাডভেঞ্চার গুলো মোটামুটি কঠিন। দ্য বেজ ক্যাম্পে শীতলতা পাওয়ার জন্য রয়েছে সুইমিংপুল। যেখানে ইচ্ছামত লাফালাফি করতে পারবেন মনের আনন্দে।
স্কুলের বাচ্চাদের জন্য রয়েছে স্পেশাল জোন ও আলাদা প্যাকেজ। দ্য বেজ ক্যাম্পে বনে ট্রেকিংসহ পুকুরে মাছ ধরারও ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও রাতে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, কমপক্ষে ২০ জন থাকা যায় আছে এমন তাঁবু। যারা একান্তই তাঁবুতে থাকতে চান না, তাদের জন্য বাংলো বাড়ি তো আছেই। তাঁবুর পাশেই চলে ক্যাম্পফায়ার উৎসব, বারবিকিউ পার্টি। বেস ক্যাম্পের অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাক্টিভিটিগুলো আপনার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে ও নিজের মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে জাগ্রত করতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন বেস ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ।
থাকার ব্যবস্থা ও খরচ
দ্য বেস ক্যাম্পে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা। ক্যাম্পে আপনি পাচ্ছেন রাত যাপনের সুযোগ। সে ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীদের জন্য রয়েছে তাঁবু অথবা কটেজ রুমে রাতে থাকার সুবিধা। সাধারণত বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটির প্যাকেজের ওপর নির্ভর করে এর খরচ। তাঁবুতে থাকার প্যাকেজগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে স্কুল-পরিবার ও করপোরেটভিত্তিক। ২০ জনের টিমের প্রতি দুজনের হিসেবে তাঁবুতে থাকতে খরচ হবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে আপনারা চাইলে থাকতে পারবেন বেস ক্যাম্পের নিজস্ব বাংলোর রুমগুলোতে। বাংলোর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সিঙ্গেল-ডাবল-ডুপ্লেক্সভিত্তিক। এসি ও এটাচ বাথরুমসহ সিঙ্গেল কক্ষের জন্য একরাতের ভাড়া গুনতে হবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। ডাবল রুম নিলে যোগ করতে হবে সঙ্গে আরও এক হাজার টাকা। এ ছাড়া ডুপ্লেক্স বাংলোর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। পরিবারের সঙ্গে বা অফিসের সহকর্মীরা মিলে ছুটির দিনে দারুণ সময় উপভোগ করতে পারবেন এই ক্যাম্পটিতে।
মেনে চলতে হবে যেসব শর্ত
দ্য বেস ক্যাম্পে প্রবেশের পর থেকে আপনাকে মেনে চলতে হবে বেশকিছু শর্ত। যেকোনো ধরনের খাবার কিংবা পানীয় নিয়ে ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করা যাবে না। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যত্রতত্র ধূমপান করা সম্পূর্ণ নিষেধ। যেকোনো ধরনের অ্যাক্টিভিটিতে অংশগ্রহণের আগে অবশ্যই আপনার ইনস্ট্রাক্টরকে যেকোনো ধরনের অসুস্থতা যেমন হাইট ফোবিয়া, অ্যাজমা, হ্রদরোগ বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। ক্যাম্পের ভেতরকার পরিবেশ বজায় রেখে ক্যাম্পে অবস্থান করতে হবে ভ্রমণকারীদের।
অ্যাডভেঞ্চারপিপাসু মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে দ্য বেস ক্যাম্প হতে পারে সেরা পছন্দ। এখানে আপনারা পাচ্ছেন এক থেকে সাত দিন পর্যন্ত ক্যাম্পিংয়ের সুযোগ। ক্যাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যেতে হবে ক্যাম্পটিতে। বুকিংয়ের সময় ক্যাম্পিংয়ের একজন ট্রেনিং গাইড বা ইনস্ট্রাক্টর দেওয়া হবে যিনি পরবর্তী সময়ে কীভাবে আপনি অ্যাডভেঞ্চারাস অ্যাক্টিভিটিগুলো উপভোগ করতে পারবেন, সে সম্পর্কিত সব ধরনের নির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করবেন।
অ্যাক্টিভিটিগুলোর ক্ষেত্রে সব ধরনের সতর্কতা ও পূর্ব প্রস্তুতি মেনে পরিচালনা করা হয় এবং ক্যাম্পিংয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ছুটির দিনগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে এই ক্যাম্পটিতে। তাই ভ্রমণকারীদের আগে থেকে বুকিং দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। বেস ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নের মাধ্যমে অতিথি ও ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের কাজটি করে থাকে। যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ও প্রকৃতির মাঝে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে পরিবার বা অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধন জোরালো করতে বেস ক্যাম্পের অ্যাক্টিভিটিগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এতে করে যেমন পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো যায়, তেমনি আবার কোমল স্নিগ্ধ প্রকৃতির পরশে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাই আপনার ছুটির দিনে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ও অ্যাডভেঞ্চার থ্রিল উপভোগ করতে ঘুরে আসুন দ্য বেস ক্যাম্প থেকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার অদূরে গাজীপুরের সফিপুরে বেস ক্যাম্প অবস্থিত। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের ঠিক পাশেই রয়েছে এ ক্যাম্প। ঢাকা থেকে নিজস্ব পরিবহন কিংবা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী যেকোনো যানবাহনে চড়ে পৌঁছে যাবেন গাজীপুর চৌরাস্তায়। সেখান থেকে খুব সহজেই সফিপুরের পূর্বপাড়া পৌঁছে যেতে পারবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থলে। বেস ক্যাম্পে পৌঁছাতে যাতায়াত খরচ ও সময় দুটোই সাশ্রয়ী হবে আপনার জন্য।