× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইতিহাসের পথে

তৈমুরের দেশে

রেজাউল বাহার

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৩ ১৫:১৪ পিএম

আপডেট : ১৩ মে ২০২৩ ১৫:১৫ পিএম

তৈমুরের দেশে

উজবেকিস্তানের তাসখন্দ এয়ারপোর্টে যখন নামলাম তখন রাত ২টা বাজে। ঘর ছেড়ে বেড়িয়েছি চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময়। নিউইয়র্ক থেকে ইস্তানবুল হয়ে তাসখন্দ। নির্ঝঞ্ঝাটহীন এয়ারপোর্ট, মানুষের কোলাহল কমে গেছে, ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস সবই বেশ ঝটপট। শরীর ক্লান্ত, চোখে ঘুম নেই অথচ ঘুমানো প্রয়োজন।

শারমীন আর আমি পনেরো বছর ধরে ভ্রমণ করছি নব্বইটির ওপর দেশ। এখন কিছুটা হলেও ভ্রমণের ব্যাপারে অভিজ্ঞ আমরা। আমাদের যেটা কমতি তা হলো সময়। দুজনেই ফুল টাইম অফিস করি। বছরে ছুটিছাঁটা হাতে গোনা। কাজেই সময়কে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। তাসখন্দ এয়ারপোর্টে নামলেও এখানে আমরা থাকব না। প্রথমে যাব বুখারা শহরে, সেখান থেকে সমরকন্দ। অবাক হলেও সত্য- উজবেকিস্তানে আছে দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেন, ঠিক ইউরোপ-জাপানের মতো। তাসখন্দ থেকে ৬শ কিলোমিটার দূরে বুখারা যেতে সময় নেবে চার ঘণ্টার কম।

আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল, ইন্টারনেটে টিকিট কাটা ছিল। রাত ৩টার অন্ধকারে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম ট্রেন স্টেশনের দিকে। গোটা তাসখন্দ শহর তখন ঘুমাচ্ছে। এ শহরে এই প্রথম আমরা। অপরিচিত সব, যোগাযোগের মাধ্যম ইংরেজি ভাষা এখানে সম্পূর্ণ অচল। সবকিছুই চলছে ইশারা-ইঙ্গিতে, আর মাঝরাতে ঘুম ঘুম চোখেও মুখটা হাসি হাসি। স্টেশনে পৌঁছাতে রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে। ফাঁকা স্টেশন, আরও চার-পাঁচজন পুরুষ ও মহিলা বেঞ্চিতে বসা, কেউ আধশোয়া। স্টেশনে প্রথম ট্রেন সকাল সাতটায়। বেঞ্চিতে বসে আর হাঁটাহাঁটি করেই পার করে দিতে হবে চার ঘণ্টা। এরপর এলো ভোরের আলো, স্টেশনের দোকানপাট খুলতে শুরু হয়েছে, মানুষের আনাগোনাও বাড়ছে। চারপাশে মানুষ থাকলেই মনে হয় সব জীবন্ত আবার।

ট্রেনে বুখারা এসে থাকলাম। এখানে দুই দিন। উজবেকিস্তানে এসে যদি একটা শহর ঘুরে চলে যেতে হয়, তবে আসতে হবে বুখারাতে। প্রাচীন শহর, হাঁটাপথে সব দেখা যায়। আড়াই হাজারের বেশি পুরাতন এই শহর সবচেয়ে জীবন্ত আজ। এখানে দুদিন থেকেই চলে এলাম সমরকন্দে। আমার গল্পের কেন্দ্রস্থল এই সমরকন্দ। মধ্য এশিয়ায় সমরকন্দ এক ঐতিহাসিক পুরোনো শহর। এক সময় সুদূর চীন থেকে ইউরোপে বাণিজ্যের পথ যা সিল্ক রোড নাম পরিচিত- তারই পথে এই সমরকন্দ। ধর্মীয় আর রাজনৈতিক ইতিহাস এখানে এতটাই জটিল, যার শুরু থেকে শেষে গেলে শুরুটা হারিয়ে যায়। শখানেক জিলাপির প্যাঁচ এক করলে যা দাঁড়ায়, তাই এর ইতিহাস। 

উজবেকিস্তানের সমরকন্দে ঘুমিয়ে আছে এক পৈশাচিক দানব। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সে বীর, নাম তৈমুর লং। ৬শ বছর আগে তার তাণ্ডবলীলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষ মারা যায়। শুধু ভারতবর্ষে এসে মানুষ মারেন এক লাখ। দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আগুন লাগিয়ে দেন নিরীহ উটের পিঠে। কেন? কারণ দিল্লির বাহিনীর ছিল হাতি। তৈমুরের ছিল উট। উটের পিঠে আগুন চাপিয়ে হাতিকে দিশেহারা করেছিলেন তিনি।

তৈমুরের ইতিহাস লোমহর্ষক। একের পর এক তিনি রাজ্য জয় করেছেন। অটোমান সাম্রাজ্যের বায়েজিদকে তিনি পরাস্ত করে খাঁচায় বন্দি করে নিয়ে এসেছিলেন সমরকন্দে। রাজপ্রাসাদের ভোজন রুমের মাঝখানে খাঁচায় বন্দি বায়েজিদ। তৈমুরের অতিথিরা উপস্থিত। বায়েজিদের স্ত্রীকে নগ্ন করে অতিথিদের খাবার পরিবেশন করতে বাধ্য করেছিলেন তৈমুর। খাবারের উচ্ছিষ্ট ছুড়ে ফেলা হতো হলঘরের মাঝে খাঁচায় বন্দি বায়েজিদের দিকে। ইতিহাসে বলা আছে, বায়েজিদ খাঁচায় মাথা ঠুকে আত্মহত্যা করেছিলেন। 

মানুষের গলা কাটা, মাথার খুলি জমা করে পিরামিড বানানো, মসজিদের মিনারের ওপর থেকে একের পর এক বন্দি সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া- ইতিহাসে এগুলো তৈমুরের খুব অল্প অংশজুড়ে আছে। তৈমুর তুরস্কের এক অংশ জয় করে প্রতিশ্ৰুতি দিয়েছিলেন কোনো রক্তক্ষরণ হবে না এই শহরে। তিনি তার প্রতিশ্ৰুতি রেখেছিলেন। সেই প্রতিশ্ৰুতি রাখতে গিয়ে তৈমুর তিন হাজার বন্দিকে জীবন্ত পুঁতে দিয়েছিলেন মাটিতে। এই তৈমুর লঙের সমাধিস্থল সমরকন্দে। সেখানে যাওয়ার অনুভূতি ঠিক এখানে লেখা গল্পের মতোই। 

সমরকন্দ প্রায় আড়াই হাজার বছরের ঐতিহাসিক পুরোনো শহর। তৈমুর এ শহরকে তার রাজধানী করেছিলেন। পুনর্নির্মাণ করেছেন তার সাম্রাজ্যের কারিগর ও স্থপতিদের দিয়ে। তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শাসক। কাজেই এখানে তৈরি হয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, সমাধিস্থলÑ যা আজও বিশ্বকে অবাক করে ভাবতে শিখায় কতটা নিখুঁত কারিগরের তৈরি এই ইমারতগুলো।

১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতায় আসে উজবেকিস্তান। সারা দেশের ভেঙে পড়া ইমারতগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়ন একে একে মেরামত করে তার মূল নকশায়। এ কারণেই এখনও দাঁড়িয়ে আছে সমরকন্দের ইমারতগুলো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক দুর্যোগে ভোগে উজবেকিস্তান। তার ৩০ বছর পরেও সেই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। উজবেকিস্তান স্বল্প আয়ের দেশ। কাজেই এখানে ভ্রমণ করা যায় স্বল্প খরচে। মানুষ এখানে বন্ধুসুলভ। যাতায়াত, পথঘাট নিরাপদ অতিথিদের জন্য।

তৈমুর লং উজবেকিস্তানের বীর। তার কালো হাতের ছাপ পৃথিবীর ইতিহাসে স্পষ্ট। কিন্তু তিনি বদলে দিয়েছিলেন তার শহর। সমরকন্দে ইমারত, মসজিদ, মাদ্রাসা এখনও এক অবাক বিস্ময়। তৈমুর লঙের গল্প এক পাতার নয়। প্রয়োজন এক লাইব্রেরিভর্তি বইয়ের, প্রয়োজন ইতিহাসবিদদের সম্মেলন। গল্পে বলা আছে, তিনি তার রাজ্যের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য সুদূর সিরিয়া থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন এক নবীর কবর। গল্পে বলা আছে, এই নবীর কবর যেখানে থাকবে, সে জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে মঙ্গলের দিকে। সেই নবীর কবর ষাট ফুট লম্বা।

উজবেকিস্তান সরকারিভাবে সে সমাধিস্থল পরিচর্যা করে। হাজারো মানুষ আসে কবরের পাশে। শারমীন আর আমি তাদেরই দুজন। একটু তফাত এই যে, বিশেষ অনুরোধে আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল কবর ঘরের দরজা। কী অবাক করা কাণ্ড! একবিংশ শতাব্দীতে আমি ষাট ফুট কবরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখেছি। সেই কবরের গল্প বলছি। আচ্ছা আসলেই কী ষাট ফুট লম্বা মানুষ ছিল? সত্য আর বিশ্বাসÑ এই দুইয়ের তফাত লুকিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তরে। এই নবীর নাম প্রফেট ডেনিয়েল। তার কবর আছে পৃথিবীর পাঁচটি দেশে, নয়টি স্থানে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা