ইরতিজা জান্নাত মীম
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১২:১০ পিএম
আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ১২:১৩ পিএম
চলতি পথে কিংবা শত ব্যস্ততায় বাঁশের বাঁশির সুর কানে এলেই মন সেদিকে টানে। কেউ কেউ দাঁড়িয়েও যান খানিকটা সময়ের জন্য। বাঁশরিয়া বাঁশিতে যে দরদভরা করুণ সুর তোলে অথবা মধুময় চনমনে কোনো ঝংকার, তা আমার আপনার মনে পুষে রাখা সুখ, আনন্দ বা বেদনারই সুরেলা প্রকাশ। তাই হয়তো মানসিকভাবে হলেও এড়ানো যায় না। মাঠ-ঘাট, তেপান্তরে রাখালিয়ার সেই বাঁশির সুর যখন ইট-পাথরের নাগরিক কোলাহলে পাওয়া যায়। তখন না দাঁড়িয়ে যাওয়াটা মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে। তাই মানসিক যন্ত্রণা না নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা মৌচাক। চারদিকে মানুষের সমুদ্র। দুপুরের ঠা ঠা রোদে গাড়ির হর্নের পিপ পিপ শব্দ ঢেউয়ের মতো গর্জন দিচ্ছে। ঘামে ভেজা ধুলোবালি মাখা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে যে যার মতো ছুটে চলেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু মানুষকে শীতল, শান্ত অনুভবে আবিষ্ট করে রেখেছেন কেউ একজন মোহন বাঁশির সুরে। যে বাঁশুরিয়ার বাঁশিতে এমন সম্মোহনী সুর, তার নাম আব্দুল মতিন। বাঁধাধরা নিয়মের কঠিন এই শহুরে সময়েও কিছু মানুষ ভিড় জমিয়েছে তার বাঁশির সুর শুনতে। নাগরিক ব্যস্ততা যেন হার মেনেছে তার বাঁশির সুরে।
আব্দুল মতিনের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। শৈশব থেকে চোখে কম দেখেন। অভারের সংসার। উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারেননি। শৈশবে শখের বসে বাঁশিতে ঠোঁট লাগিয়েছিলেন। এখন এটিই তার মুখে ডাল-ভাত তোলার একমাত্র অবলম্বন। মনের খোরাকে জোগাড় হয়; সেই সঙ্গে পেটের খোরাকও। হতদরিদ্র বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে মতিন একজন। আর ভাই-বোনেদের মধ্যে তার জীবনের গল্পটা একেবারেই ভিন্ন। কারণ সে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। জন্মগতভাবে তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। দেহটাও অতিকায় ক্ষীণ। ভারী কাজ একদমই করতে পারেন না।
আব্দুল মতিনের কাছে বাঁশি বাজানো প্রসঙ্গ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার গুরু আমি নিজেই। ছোটবেলায় মেলায় গিয়ে শখ করে বাঁশি কিনেছিলাম।’ তার পর সেই বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে আজ তিনি বাঁশুরিয়া। যদিও কখনও ভাবেননি, এই শখের বাঁশিই হবে তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। মনে যার এত সুর, তার চোখে কোনো আলো নেই। আক্ষেপ করে বললেন, ‘এইজন্য লেখাপড়াও করতে পারি নাই।’ তবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দিন ও রাতের পার্থক্য অনুভব করতে পারেন। রাতের অন্ধকারে কেউ আলো জ্বালালে বুঝতে পারেন। তবে, বিধাতার দেওয়া স্থূল শারীরিক গড়ন ও অন্ধত্বের কারণে তাকে প্রেম, ভালোবাসার মতো অনুভূতিগুলোকে মাটিচাপা দিতে হয়েছে। যৌবনে এক মেয়ের প্রেমে পড়লেও কখনও সেটা বলার সাহস করতে পারেননি। সংসারও তার ভাগ্যে নেই। বিশেষ চাহিদার প্রতিবন্ধকতায় সংসার ভেঙেছে বিয়ের তিন মাসের মাথায়। কাচের মতো তছনছ হয়ে যায় ঘর-সংসারের স্বপ্ন। এখন বাঁশিই এই বাশুঁরিয়ার প্রাণ ও প্রিয়া। প্রচলিত বাংলা গানের পাশাপাশি নিজের বানানো বেশকিছু করুণ সুরও বাজান আব্দুল মতিন। মনে দুঃখ, বেদনা, আবেগ থাকলে তবেই বাঁশিতে তা ফুটিয়ে তোলা যায় বলে তার বিশ্বাস। প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী ও বংশীবাদক বারী সিদ্দিকীর ভীষণ ভক্তও।
মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ও খালিদ হাসান মিলুর গাওয়া তুমুল দর্শকপ্রিয় বাংলা সিনেমার ‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন’ গানের সুর বাঁশিতে তুলতে তিনি খুব ভালোবাসেন। এই গানই তার জীবনের প্রতিচ্ছবি, প্রত্যেকটা লাইনে তারই মনের অনুচ্চারিত কথাগুলো খুঁজে পান বলে জানালেন। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বাড্ডা, মৌচাক ও সেগুনবাগিচা এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজান মতিন। মধুর বাঁশির সুর শুনিয়ে পথচারীদের মুগ্ধ করেন। বাঁশির সুরে খুশি হয়ে শ্রোতারা ১০, ২০, ৫০ টাকা করে যা দেন, সেটাই তার রোজগারের একমাত্র সম্বল। দিনশেষে যা আয় করেন তিনি, তার সবটাই দিয়ে দেন ভাইবোনদের। পাঁচ বছর আগে বাবা-মাকে হারিয়েছেন। তাই পরিবার বলতে এরাই সব। আর তো কেউ নেই। তবু আব্দুল মতিনের আলোহীন চোখে ঝলমলে জীবনের স্বপ্ন।