আব্দুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৪৬ পিএম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৫১ পিএম
বগুড়া জেলার লাল টুকটুকে মরিচের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে ছবি: অনিন্দিতা রায়
কথায় আছে মাছের রাজা ইলিশ আর ঝালের রাজা লাল মরিচ। নিরীহ দর্শন এই মরিচ আমাদের স্থানীয় ফসল না হলেও কালের বিবর্তনে তা এখানকার মানুষের দৈনন্দিন রসনার অংশ হয়ে গেছে। বাঙালির রান্নায় তাই ঝাল না হলে যেন চলেই না। আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় মরিচের চাষ হলেও বগুড়া জেলার কয়েকটি উপজেলা লাল মরিচের জন্য বেশ বিখ্যাত। এ বিষয়ে বিস্তারিত...
ঝালপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নিরীহ দর্শন মরিচই যে ঝালের মূল কারিগর সেটা না বললেও চলে। কয়েক হাজার বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে মানুষের রসনায় স্বাদ জোগাচ্ছে ঝাল তথা মরিচ। পর্তুগিজদের হাত ধরে মরিচ আমেরিকা মহাদেশ থেকে এশিয়া মহাদেশে এসে খাবারে নতুনত্ব নিয়ে আবার পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে ভারতীয় বা এশিয়ান রান্নামাত্রই ঝোঁকটা বেশি ঝালের দিকে। তাই মরিচ এ অঞ্চলের রান্নার এক অপরিহার্য উপাদান। অথচ এর আদি নিবাস মেক্সিকোতে। ভারতবর্ষে এই মরিচের কোনো উৎস পাওয়া যায় না প্রাচীনকালে। তবে গোলমরিচ ব্যবহৃত হতো এ অঞ্চলের রান্নায়। ইতিহাস বলছে, আদি ভারতে অন্য অনেক মসলার ভেতর ঝালের জন্য মাত্র তিন ধরনের মসলার প্রচলন ছিল। আর তা হলো জিরা, গোলমরিচ ও সরিষা।
মরিচ নামের ঝালের অগ্নিপিণ্ডটি ভারতবর্ষে আসে পর্তুগিজদের হাত ধরে মোগল আমলে। আদতে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে এই বস্তুটির কথা বাকি পৃথিবী জানতই না।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে মরিচ দেখতে পান। ভারতবর্ষে উৎপন্ন গোলমরিচের মতো ঝাল বলে তিনি এগুলোকে ‘পিপার’ নাম দেন। যদিও গোলমরিচের গাছের সঙ্গে মরিচগাছের সম্পর্ক নেই। কলম্বাসের আমেরিকায় প্রবেশের পর থেকে মরিচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দিয়াগো আলভারেজ নামের একজন চিকিৎসক কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের সময় পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে মরিচ স্পেনে নিয়ে আসেন। তিনি ১৪৯৪ সালে মরিচের ঔষধি গুণ নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। স্পেনের ব্যবসায়ীরা মরিচ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান। প্রথমে ফিলিপাইন এবং পরে ভারতবর্ষ, চীন, কোরিয়া ও জাপানে মরিচ বিস্তার লাভ করে।
আমাদের দেশেও বিভিন্ন জেলায় মরিচ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে বগুড়া জেলার লাল টুকটুকে মরিচের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। বগুড়ার গাবতলী, সারিয়াকান্দি ও ধুনট লাল মরিচের জন্য বিখ্যাত। যমুনা ও বাঙালি নদীর চরাঞ্চল ও অন্য এলাকার জমিতে পলি জমায় এখানকার মরিচের বাম্পার ফলন হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১৪-১৫ মণ মরিচ পাওয়া যায়। গুণগত মান ভালো বলে এর চাহিদাও দেশব্যাপী। মরিচের মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল) চাষিরা বিশাল এলাকাজুড়ে মরিচ শুকানো এবং বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকে। লাল মরিচ প্রক্রিয়াজাত করার জন্য অনেক নামকরা মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বগুড়ায় নিজস্ব মরিচের খামারও রয়েছে।
মরিচ লাগানোর ৬০ থেকে ৭০ দিনের মাথায় চাষিরা তা উঠানো শুরু করেন। প্রতি সপ্তাহে একবার করে প্রায় তিন মাস একটানা মরিচ উঠানো হয়। বগুড়ার লাল মরিচগুলো জমি থেকে উঠানোর পর চাষিরা তা যমুনার পাড়ে একটানা ১৫ দিন শুকিয়ে থাকে।
মরিচ চাষে বাড়ির নারীরাও সমানভাবে সংযুক্ত থাকেন। মরিচ লাগানো, উঠানো, শুকানো ও বস্তায় ভরা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পুরুষকে সহযোগিতা করেন নারীরা। বাড়তি আয়ের আশায় সবাই একযোগে মরিচের ক্ষেতে ব্যস্ত থাকেন।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার শোনপচা চরের কৃষক মামুন প্রামাণিক। তিনি গত বছর আট বিঘা জমিতে মরিচের আবাদ করেছিলেন। তখন কাঁচা মরিচ বিক্রি করেছিলেন ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে। আর প্রতি মণ শুকনা মরিচের দর উঠেছিল ১১ হাজার টাকা। এবার কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা মণ এবং শুকনা মরিচের দর উঠেছে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এবার দাম বেশি হলেও মরিচের আবাদ তিন বিঘা কমিয়ে দেওয়ায় লাভের অঙ্কটা কমেছে মামুন প্রামাণিকের। এ কারণে আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এবার দাম বাড়ব জানলে আরও বেশি জমিতে মরিচের আবাদ করনুনি (করতাম)। আগের বছর ভালো দাম পাইনি। তাই এ বছর কম জমিতে মরিচের আবাদ করছি। কিন্তু এখন দেকিচ্চি মরিচের দাম গত বছরের তুলনায় দ্যাড় (দেড়) থেকে দুই গুণ বেশি। কেসক (কি জন্য) যে এই ভুলটা করনু।’
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, রবি (অক্টোবর থেকে মার্চ) এবং খরিপ (মার্চ থেকে জুন) মৌসুমে দেশি এবং হাইব্রিড জাতের মরিচের আবাদ হয়ে থাকে। অবশ্য ওই দুই মৌসুমের মধ্যে রবি মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৯১ শতাংশ জমিতে মরিচের আবাদ হয়ে থাকে। তবে এর বাইরে কোনো কোনো কৃষক বছরের অন্য সময়ও মরিচের আবাদ করে থাকেন। জেলায় মোট মরিচের প্রায় অর্ধেক আবাদ হয়ে থাকে সারিয়াকান্দি উপজেলা এলাকায়। গাছ রোপণের দুই মাস পর অর্থাৎ ডিসেম্বর ও জানুয়ারি থেকে কাঁচা মরিচ তোলা শুরু হয়। আর যারা মরিচটি শুকনা আকারে বিক্রি করতে চান তারা আরও দুই থেকে আড়াই মাস অপেক্ষা করেন। আবাদ করা মরিচের মধ্যে ৪৪ শতাংশই কাঁচা অবস্থায় উত্তোলন করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৪ মেট্রিক টন করে ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত কাঁচা মরিচগুলো স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করা হয়। বৃহৎ কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পরিবেশকদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে শুকনা মরিচ সংগ্রহ করে থাকে।
সারিয়াকান্দি উপজেলার মরিচের পাইকারি ব্যবসায়ী হযরত আলী জানান, গত বছর কাঁচা মরিচ কিনে তার লোকসান হয়েছিল। তবে এবার দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা ভালো মুনাফা করেছেন। স্কয়ার কোম্পানির স্থানীয় পরিবেশক সুমন মিয়া জানান, তিন মণ লাল টোপা মরিচ শুকিয়ে এক মণ শুকনা মরিচ পাওয়া যায়। এবার শুকনা মরিচের বাজার বেশ ভালো। প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকায়।
** প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর বগুড়া ব্যুরোপ্রধান মোহন আখন্দ ও সারিয়াকান্দি প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম