রবিউল হুসাইন
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১৩ পিএম
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪৯ পিএম
গরমে শীতল পরশ পেতে তালপাতার পাখার জুড়ি নেই। একসময় আমাদের চিরায়ত বাংলায় তালপাতার পাখার ব্যাপক প্রচলন থাকলেও বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নয়নে এ পাখার আবেদন অনেকটাই কমে গেছে। সে স্থান দখল করেছে বৈদ্যুতিক পাখা ও চার্জার ফ্যান। গ্রামের হাটে, মেলা ও উৎসবে আগে তালপাতার পাখা অহরহ বিক্রি হলেও এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় ও তালপাতার সংকটের কারণে পাখা তৈরির কারুশিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ জোয়ারা গ্রামটি একসময় তালপাতার পাখা তৈরির জন্য বেশ পরিচিত ছিল। এ গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই তালপাতার পাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বছরজুড়ে এখানে তৈরি হতো বিভিন্ন আকার আকৃতির তালপাতার পাখা। সেগুলো বিক্রি হতো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলাসহ বিভিন্ন লোকজ উৎসবে। বিশেষ করে বৈশাখী মেলা ছিল এ পাখা বিক্রির অন্যতম জায়গা। সময়ের পরিক্রমায় দক্ষিণ জোয়ারা গ্রামে আগের মতো তালপাতার পাখা এখন তৈরি না হলেও বেশ কয়েকটি পরিবার এখনও এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তারা পাখা তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। বংশপরম্পরায় তালপাতার পাখা তৈরি করে নির্বাহ করছে জীবিকা।
বৈশাখী মেলা ছাড়াও স্থানীয় পারিয়া শান্তির হাট, কেরানী হাট ও দোহাজারী হাটেও এসব পাখার বিকিকিনি চলে। সচরাচর হাটে বাজারে যেসব তালপাতার পাখা দেখতে পাওয়া যায় সেসব পাখার সঙ্গে দক্ষিণ জোয়ারা গ্রামের তালপাতার পাখার বিস্তর ফারাক রয়েছে। এখানকার পাখা সূক্ষ্ম বুনন ও বাহারি ডিজাইনে তৈরি করা হয়। বিশেষ নকশার কারণে এ পাখার আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। কয়েকশ বছর ধরে এ গ্রামে এসব পাখা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে তালগাছ দিন দিন কমে যাওয়ার কারণে আগের মতো তালপাতা সংগ্রহ করা যায় না। তা ছাড়া উচ্চমূল্যে তালপাতা কিনে পাখা তৈরি করে তেমন মুনাফাও পাওয়া যায় না তাই নতুন করে কেউ এ পেশায় উৎসাহিত হচ্ছেন না।
ছোটবেলা থেকে পাখা তৈরি কাজের সঙ্গে জড়িত বাপ্পারাজ জানান, তার বাবা ও দাদা এ পাখা তৈরি করেছেন। তিনিও পাখা তৈরি করছেন। নকশা করা তালপাতার পাখা তৈরির বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমেই গাছ থেকে তালপাতা সংগ্রহ করতে হয়। আগে বিনা টাকায় বিভিন্ন গাছ থেকে তালপাতা সংগ্রহ করলেও এখন নগদ টাকায় পাতা কিনে আনতে হয়। চট্টগ্রামের পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও চেলিশহর এলাকায় বিপুলসংখ্যক তালগাছ রয়েছে। সেখান থেকেই তালপাতা কিনে আনেন তারা। প্রতি গাছ ৩০০ টাকায় কিনতে হয়। এ তালপাতা কাটার জন্য গাছপ্রতি গাছিকে দিতে হয় ২০০ টাকা। রয়েছে যাতায়াত ভাড়াও। একটি গাছ থেকে তালপাতা কাটলে পরবর্তী দুই বছর সে গাছ থেকে আর পাতা কাটা যায় না। তালপাতা এনে এগুলোকে চির করা হয়। পরে কেমিক্যালের মাধ্যমে গরম পানিতে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে পাখা বুননের উপযোগী করা হয়। তুলনামূলক কচি পাতার পাখা সবচেয়ে ভালো হয় বলে জানান পাখা তৈরির শিল্পী বাপ্পারাজ। তালপাতা চিরে বিভিন্ন ধরনের রঙ করে সেগুলো দিয়ে বাহারি রঙের পাখা তৈরি করা হয়। বাপ্পারাজ ছাড়াও তার পরিবারের সবাই পাখা তৈরি করতে পারেন।
আকার-আকৃতি ভেদে মোট চার ধরনের পাখা তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রঙ ছাড়া পাখা, ফুল ডিজাইনের পাখা, রুইতন ডিজাইনের পাখা ও সাধারণ পাখা। এসব পাখা ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। তালপাতার পাখা তৈরির ক্ষেত্রে এর হাতলের জন্য ব্যবহার করা হয় চিকন বাঁশ আর বৃত্তাকার কাঠামো তৈরি করা হয় বেত দিয়ে। নান্দনিক ডিজাইনের এসব পাখা রুচিশীল মানুষের কাছে এখনও বেশ জনপ্রিয়। প্রচণ্ড গরম থেকে একটু প্রশান্তির জন্য তালপাতার পাখা যেমন স্বস্তি এনে দেয় তেমনি এর দৃষ্টিনন্দন নকশা ও কারুকাজ বাংলার লোকজ ঐতিহ্য সবার কাছে ফুটিয়ে তোলে।