কাইজার চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৫৪ এএম
ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতির কথা কইতে বলছ তো? তা তোমার আবদারটা রক্ষা করতে পারাটা কী এমন কঠিন কাজ, বলো? এমন এক আবদার আমাদের শুনতে হয়েছিল এই তো বছর কয়েক আগে। আমার বয়ান ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল একটা পত্রিকায়। এখন সেই পত্রিকাটি খুঁজে আমার বয়ানটুকু টুকলিফাই করতে পারলেই তো কেল্লা ফতে, তাই না? হেহ্ হেহ্! একে বলে বুদ্ধিতে বাজিমাত। ... না হে!
শেষতক ভুল-বকাবাজি করে গেলাম বোধহয়! পত্রিকাটা খুঁজে কুপোকাত আমি, তা জানো? তাই তো একটু পেরেশানিতে আছি। এখন দিব্যি মালুম হচ্ছে, ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়ানোর মতন ঝক্কিমারি কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। বলে কি না সক্কাল বেলা নাশতার টেবিলে পাউরুটি ছিল নাকি পরোটা, সেই দুপুর না গড়াতেই বেমালুম ভুলে বসে থাকি, আর এখন জানত চাইছ কি না ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগের সেই ডাইনোসরদের হটোপুটি আমলের বৃত্তান্ত? হাহ্!
তবে আবদারটি যখন করেই ফেলছ, তখন তোমাদের নিরাশ না করে বলে যাই না হয়- যতটুকুন মনে পড়ে আমারÑ কী বলো?
ক্রম আকারে সাজালে আমার স্মৃতিচারণা অনেকটা একভূত : ঊনপঞ্চাশে ঢাকার মাহতটুলির নানাবাড়িতে জন্ম আমার। তিপান্ন পর্যন্ত- মানে হামাগুড়ির বয়স থেকে মুখে বোল ফোটা অব্দি কী ঘটেছিল নাকি আদৌ কিছু ঘটেছিল কি না- স্মরণে নেই।
চুয়ান্ন থেকে ঊনষাট অব্দি সময় কেটেছে গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের দাদাবাড়িতে। ঈদে নতুন কোনো পোশাক চড়াতে পেরেছিলাম কি না, মনে পড়ে না। একবার বোধকরি নানার-বরাতে সদরঘাট ‘অমৃত বস্ত্রালয়’ থেকে দুটো চমৎকবার শার্ট কেনা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, শার্ট দুটো গলগ্রহ হয়ে আমার আশ্রয়ে টিকতে পারেনি খুব বেশিদিনÑ একদিন চোখ মেলে দেখি, শার্ট দুটো উধাও। ... ঈদ ঘনিয়ে আসতেই, রোজ বিকেলে রাস্তার মোড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম- এই বুঝি নানার গাড়ির নাকের ডগাটি আমাদের গলির মোড়ে দৃশ্যমান হবে। গাড়ির ভেতর নানা আর বড় নয়তা ছোট মামা।
অবশ্যিই আমার জন্যে এত্ত এত্ত উপহার । ... ধর্মকর্ম পালন করতে এতটুকু ক্লান্তি ছিল না আমার দাদার। রোজা রাখতেন তিরিশটি দিন। ইফতারের জন্যে ছোলাবুট, খুরমা, মুড়ি, পেঁয়াজ ছাড়াও থাকত শরবত। শরবতকে শীতল করতে মিলব্যারাকের বরফকলে গিয়ে দু-আনার (নাকি এক আনার) বরফ কিনে নিয়ে আসতাম। ... দূর মসজিদের অ-মাইক আজানের ধ্বনি শোনা যেত না, তবে সবার সুবিধের জন্য ইফতার আর সেহরির সময় সাইরেন বাজানোর রেওয়াজটি ছিল। আর ঈদের চাঁদ দেখা দিলে ইফতারে পর দ্বিতীয়বারের মতন সাইরেন রেজে উঠত। ... ঈদের চাঁদ বাড়ির উঠোন থেকেই দ্যাখা যেত, তবে ধূপখোলা মাঠে গিয়ে সবাই মিলে চাঁদ দ্যাখার মজাটাই ছিল আলাদা। তারপর ঘরে ফিরে বয়োজ্যেষ্ঠদের চরণ-ছুঁয়ে সালাম করাটা ছিল দস্তুর। সালামের দ্বিতীয়-পর্বটা হতো গিয়ে নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পর। অনেক দিন বাদে শুনেছি, দ্বিতীয় সালাম শেষে নাকি সালামি হিসেবে কিছু নগদ-নারায়ণ পকেটস্থ করাটাও বিধিবদ্ধ একটা সংস্কার; যখন শুনলাম ততদিনে বয়স-বেলা অনেকদূর গড়িয়েছে, তাই এক আক্কেল সেলামি ছাড়া আমার কপালে কিছুই জোটেনি।… ঈদের দিনে বাড়িতে মায়ের হাতের জর্দা সেমাই খেয়েই বেরিয়ে পড়তামÑ এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে জুটিয়ে নিতাম আধডজন ইয়ার বন্ধু। সবাই মিলে ঢুঁ দিতাম পাড়ার যত ইয়ার বন্ধুদের বাড়ি। যার যার নতুন পোশাকের জেল্লার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে, কার বাড়ির সেমাইটি সবচেয়ে আহামরি হয়েছে, কার বাড়ির ফিরনি- এসব উপাদেয় বিষয়বস্তুকে নিয়ে চলত একটানা আলোচনা-বিতর্ক। এমনি করেই গেণ্ডারিয়ার সূর্যটা একসময় পাশের রেললাইন পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ নাকি মুন্সীগঞ্জ- কোথায় যেন হারিয়ে যেত।… ‘সাধনা’র কাছে গেণ্ডারিয়ার মসজিদটি তখনও পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেনি- তাই ঈদের জামায়াতটা বরাবর ধূপখোলা মাঠেই অনুষ্ঠিত হতো। একবার বাড়ির সবাই দাদার পিছু নিয়ে ধূপখোলায় গিয়েই ছলছল চোখে আবিষ্কার করি- নামাজ নাকি এই মাত্তর শেষ, আর সক্কলে মিলে কোলাকুলির প্রতিযোগিতায় মেতেছে। ‘মুরব্বিদের মধ্যে জবরদস্ত তর্কাতর্কির ভাষা শুনে সমঝে নিতে হলো, গত রাতে পাড়ার জামাত অনুষ্ঠানের সময়সূচিটা ঠিকমতো শোনাতে পারেননি দায়িত্ববানরা। কিংবা আমরাই হয়তো কানে খাটো! অগত্যা দ্বিতীয় এক জামায়াতের আয়োজন। অংশ নিলাম বাড়ির সবাই এবং আমাদের মতনই কানে খাটো পাড়ারই গুটিকয় ভুক্তভোগী। ইমামতি করলেন আমার দাদা। এত ছোট ঈদের জামাত দেড় হাজার বছরে কেউ দেখেছে কি না সন্দেহ।…এই দাদার কাছেই আমার পবিত্র কোরআন পাঠে হাতেখড়ি। এই দাদার পবিত্র কোরআন শরিফের পাশেই রেখে দিতাম আমি বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা ফুলের পাপড়ি। … আহা! দাদা যদি জানতেন- জানতাম যদি আমি!- এই তেরো কি চৌদ্দ বছর পরে (১৯৭১ সালে) ফজরের নামাজ শেষে গায়ের পারিবারিক মসজিদ থেকে বেরোবার মুখে পাক-দখলদারদের গুলিতে শহীদ হতে হবে তাকে!