মেহেরাব হোসেন অপি
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৩১ পিএম
আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জনের জন্য সেহরির আয়োজন করেন। বিকাল থেকেই চলে তার প্রস্তুতি। শুরু হয় চাল ধোয়া-বাছা কিংবা তরিতরকারির জন্য মসলা তৈরির কাজ। সবকিছু গুছিয়ে শুরু করেন রান্না। রান্না শেষে খাবার নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালের রোগী ও তার স্বজনদের কাছে। প্রত্যেক দিন খাবার পৌঁছে দেওয়া এই রমজান মাসে তার নিত্যাদনের দায়িত্ব। তার খাবার দেওয়া দেখে প্রথমে কেউ অনুমান করতে পারেন তিনি হয়তো কোনো খাবার বিক্রেতা! আসলে এই খাবারের জন্য তিনি কারোর কাছ থেকে নেন না একটি পয়সাও। নিজের গাঁটের অর্থ এবং নিজের হাতে তৈরি করা খাবার দিয়ে সেবা করে যাচ্ছেন অনাত্মীয় ও অপরিচিত স্বজনদের। এই কাজকে তিনি মানবিক দায়িত্ব মনে করেন। এতো সময় যার কথা বলছি তিনি মেহেরপুর জেলা শহরের ওয়াপদাপাড়ার বাসিন্দা নুরুন্নাহার বেগম। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনদের জন্য আট বছর ধরে বিনামূল্যে সেহরির ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। তার এই মানবিক কাজের পেছনের গল্প জানতে চাইলে নুরুন্নাহার বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ২৫ রমজানে একমাত্র ছেলে নাহিদুজ্জামান খানকে হারানোর পর দুনিয়াদারি নিছক মনে হয়। একদম বিমর্ষ অবস্থার মধ্যে ছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, বেঁচে থাকলে ছেলের জন্য যে খরচ তিনি করতেন, সেটাই ব্যয় করে ছেলের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। জেলার
বিভিন্ন গ্রামের রোগী ও রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের জন্য সেহরির আয়োজন করার মধ্য দিয়ে তিনি মৃত ছেলের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই এই কাজ করে যেতে চান তিনি।’
নুরুন্নাহারকে প্রশ্ন করা হয়- দৈনিক এত মানুষকে খাওয়ান। এর খরচ তো আছে। নুরুন্নাহার জড়ানো কণ্ঠে বলেন, হাসপাতালের সামনে নাহার ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান চালাই। দোকানের লাভের একটি অংশ রেখে দিই এই সেবার জন্য।’
হাসপাতালের সামনে ওষুধ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিনু বলেন, নুরুন্নাহার আপা খুব ভালো মনের মানুষ। ছেলের মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তার কাজের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তিনি তার ছেলেকে স্মরণ করছেন, ঠিক তেমনি তার দেওয়া সেহরি খেয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ রোজা রাখছেন।’ একই এলাকার ফল ব্যবসায়ী পলাশ হোসেন বলেন, নাহার আপা প্রতিদিন ২শ থেকে ২৫০ জনের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করেন। মানুষজন নাহার আপার তৈরি করা সেহরি তৃপ্তিসহকারে খেয়ে রোজা রাখেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তার হারানো ছেলের জন্য দোয়া কামনা করেন।
মেহেরপুর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নারগিস আক্তার বলেন, পবিত্র রমজান মাসে হাসপাতালে থাকা রোগীর স্বজনদের জন্য নাহার আপার সেহরি অনেক উপকারে আসে।’ হাসপাতালে ভর্তি রুকাইয়া ইসলাম নামের এক রোগীর মা বলেন, আমাদের বাড়ি মেহেরপুর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। এখানে আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তিন দিন ধরে এখানে মেয়েকে নিয়ে ভর্তি আছি। প্রতিদিনই নাহার আপার দেওয়া সেহরি খেয়ে রোজা থাকছি।’ জাহানারা খাতুন নামের রোগীর অন্য এক স্বজন বলেন, নাহার আপার সেহরি না পেলে কলা পাউরুটি বা বাসি পান্তা খেয়ে হয়তো রোজা থাকতে হতো। আল্লাহ যেন ওনার ছেলেকে জান্নাতবাসী করেন।’
এমন শত শত রোগীর স্বজনরা নুরুন্নাহারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জমির মোহাম্মদ হাসিবুস ছাত্তার বলেন, নুরুন্নাহারের কাজ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আট বছর ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিনি দ্বীনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার জন্য সব সময় সহযোগিতা থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, নুরুন্নাহার বেগমের খাবার তিনি নিজেও পরীক্ষা করে দেখেছেন। তার তৈরি প্রতিটি খাবারই স্বাস্থ্যসম্মত।’