মনিরুল হক রনি
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪৩ পিএম
আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০০ পিএম
এক হাজার কিংবা দুই হাজার নয়, একসঙ্গে ১০ হাজার মানুষের ইফতার। শুনে অবাক মনে হলেও বাস্তবে সেটিই হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা রওজা শরিফে। আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে প্রতিবছর রমজান মাসব্যাপী এই বিপুল মানুষের ইফতারের আয়োজন হয় এখানে। বিশাল সমারোহে ইফতারির এত বড় আয়োজন দেশের আর কোথাও হয় না বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। শুধু তাই নয়, পবিত্র কাবা শরিফের পরে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইফতার আয়োজন বলেও মনে করা হচ্ছে। ধনী-গরিব নির্বিশিষে সব মানুষ ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে বসে ইফতার করেন এখানে। আগে প্রতিদিন ১০ হাজার রোজাদার একত্রে বসে ইফতার করলেও করোনাপরবর্তীকালে বর্তমানে ৭ হাজার রোজাদার ইফতার করেন। বাকি তিন হাজার রোজাদারের ইফতার পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও অসহায়দের মধ্যে। ইফতারির আগমুহূর্তে স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা চলে আসেন এই আয়োজনে শামিল হতে। সুষ্ঠুভাবে ইফতার পরিবেশনের জন্য এখানে রয়েছে টিন দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী বিশাল ছাউনি। এই ছাউনির নিচে রোজাদারদের জন্য পরিবেশন করা হয় সাত পদের ইফতার। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৬শ মণ দুধ দিয়ে তৈরি সুজির ফিরনি, ডিম, ছোলা, চিঁড়া, কলা, খেঁজুর ও সিঙ্গাড়া। পানিরও সুব্যবস্থা থাকে প্রত্যেক রোজাদারের জন্য। দৈনিক প্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয় এই ইফতারের পিছনে, যার পুরোটাই আসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত দান থেকে।
প্রতিদিন খুব ভোর থেকেই চলে ইফতারের এ মহা আয়োজন। এখানে নিয়োজিত বাবুর্চিরা ফজর নামাজের পর থেকেই শুরু করেন তাদের কর্মযজ্ঞ। বিকাল পাঁচটা অবধি শেষ হয় ইফতার তৈরির সব কাজ। প্রায় ৩শ স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে বিকাল পাঁচটার পর থেকে শুরু হয় প্লেটে প্লেটে ইফতার পরিবেশন। এত পরিশ্রম, তবু যেন কোনো কষ্টই মনে হয় না ইফতার তৈরি ও পরিবেশনে নিয়োজিত কর্মীদের। প্রতিবছর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা স্থানীয় যুবক সেলিম হোসেন বলেন, ‘আমি দশ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে আসছি। অথচ কখনই আমার কাছে এটি কষ্টকর মনে হয়নি। বরং এ কাজে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি গর্ববোধ করি।’ একই ধরনের কথা এখানকার বাবুর্চিদেরও। এখানে কাজ করতে পেরে তারা যে খুশি, তা তাদের কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকাল শুরু হতেই আস্তে আস্তে ইফতার প্রাঙ্গণ মুখরিত হতে থাকে। শুধু যে নলতা বা এর আশপাশের রোজাদাররাই এখানে ইফতার করতে আসেন এমন নয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর (রা.) প্রতি ভালোবাসা, অশেষ নেকি হাসিল ও একসঙ্গে অনেক মানুষের সঙ্গে ইফতার করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকেও ছুটি আসেন অনেকে। নলতার এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদ বলেন, প্রতি শুক্র ও শনিবার ইফতারের জন্য ছুটে আসি নলতা শরিফে। এমনই আরেকজন আব্দুল লতিফ। তিনি এসেছেন মাগুরা থেকে। তিনি এক সঙ্গে অনেকের ইফতার করার কথা শুনে এসেছেন দেখতে। এখানে এসে তিনি শিহরিত এত মানুষের সঙ্গে ইফতার করতে পেরে।
বিশাল সমারোহে ইফতারির এই আয়োজনের শুরুটা অনেক আগ থেকেই। ‘স্রষ্টার ইবাদত এবং সৃষ্টির সেবা’Ñ এই ব্রত নিয়ে ১৯৩৫ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক হজরত শাহ্ ছুফী আলহাজ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র.) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর রমজান মাসে তিনি গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য স্বল্প পরিসরে ইফতারের ব্যবস্থা করতে থাকেন। সেই থেকে শুরু। তার পর এর পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। ক্রমান্বয়ে এটি আরও বাড়বে বলে জানালেন যশোর সরকারি সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও নলতার খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মনিরুল ইসলাম। তার ভাষ্যমতে, খান বাহাদুরে আহ্ছানউল্লাহর (র.) হাত ধরে ইফতারের যে সূচনা হয়েছে তা থামবার নয়। এটি অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে যুগ-যুগান্তর।