× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অটিজম: ভ্রান্ত ধারণার দেয়াল ভেঙে

আসমাউল হুসনা

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪৪ পিএম

অটিজম আক্রান্ত শিশুর মায়েদের সংগ্রাম করতে হয় তার পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে                         ছবি: সুমন ইউসুফ

অটিজম আক্রান্ত শিশুর মায়েদের সংগ্রাম করতে হয় তার পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে ছবি: সুমন ইউসুফ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও তার পরিবারকে হাজারো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। এ বিষয়ে হাজারো ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে। সামাজিকভাবে এর যেন কোনো প্রতিকার নেই। ২ এপ্রিল পালিত হলো বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ বিষয়ে বিশেষ লেখা...


এক কেজি ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে ছোট্ট রিমি। জন্ম থেকে সারাক্ষণই জিহ্বা বের করে রাখত বলে আশপাশের মানুষজন তাকে রাক্ষস বাচ্চা বলতেও দ্বিধাবোধ করেনি। মানুষজনের নানান কথা ও বাচ্চার অস্বাভাবিক মুখশ্রী দেখে জন্মদাত্রী মা করেছিলেন মৃত্যু কামনা। এভাবেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য নিয়ে বড় হতে থাকে ছোট্ট রিমি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো যেন আরও প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। অস্বাভাবিক জেদ, কথা বলায় ত্রুটি, দেড়িতে হাঁটা- এই আচরণগুলোর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছিল সে এক বিশেষ শিশু। সেই ছোট রিমির বয়স এখন ১৮ বছর। ১২ বছর যাবৎ সে তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষ স্কুলে অধ্যয়ন করছে। তবে তার মস্তিষ্ক এখনও ১০ বছর বয়সী শিশুর মতোই। স্কুলের সঠিক কাউন্সেলিং, প্রশিক্ষণ ও যত্নে রিমির মাঝে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। সে এখন নৃত্যে পেয়েছে সফলতা। 

রাজধানীর পূর্ব গোড়ান এলাকার মিতা মণ্ডল ও সুসান্ত কুমার মণ্ডলের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুমিত কুমার মণ্ডল। ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও অপরিচিত কারও কোনো কথার জবাব দেওয়া তো দূর কথা, কারও চোখে চোখ রাখতে পাড়ত না সে। স্কুলেও ভর্তি নেওয়া হয়নি তাকে। একটা পর্যায় সুমিতের পরিবার বুঝতে পারে সে এক বিশেষ শিশু। এরপরই তাকে ভর্তি করা হয় বিশেষায়িত স্কুলে। শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণে সুমিত প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি গান ও তবলায় হয়ে উঠছে দক্ষ।

রিমি ও সুমিতের আচরণগত ভিন্নতা থাকলেও তারা উভয়ই অটিজম আক্রান্ত শিশু। দুজনই বর্তমানে সুইড বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে পৃথক দুটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষার্থী।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় অনেকেরই অটিজম সম্পর্কে জ্ঞান খুবই স্বল্প                                                ছবি: সংগ্রহ

এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে অনেকেরই অটিজম সম্পর্কে জ্ঞান খুবই স্বল্প। গ্রামীণ অসচ্ছল পরিবারে কোনো শিশু যদি অটিজম আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তবে পরিবার ও এলাকার লোকজন ধরেই নেয় এটি তার মা-বাবার বড় কোনো পাপের ফল। তা নিয়ে কটু কথা শোনাতেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর অস্বাভাবিক আচরণে সুচিকিৎসা না করে ধারণা করা হয় তাকে জিনে আসর করছে কিংবা খারাপ বাতাস লেগেছে অথবা বলা হয় শিশুটি পাগল। তাই শিশুটিকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে করানো হয় গ্রামীণ কবিরাজি চিকিৎসা। অনেক সময় বেঁধে রাখা হয় শিকলে।

শহর হোক কিংবা গ্রাম, অটিজম সম্পর্কে জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, অটিজম আক্রান্ত শিশুর মায়েদের পাড়ি দিতে হয় বিবর্ণ এক পথ। যেখানে সামাজিক, পারিবারিক করুণার দৃষ্টিতে তাদের দেখা হয়। কোনো কারণ ছাড়াই তাদের সাব্যস্ত করে অজানা পাপের ফল। পথেঘাটে শুনতে হয় তাদের সন্তানদের অসুস্থতা নিয়ে কত কথা। অনেক সময় পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতেও ডাকা হয় না তাদের। তাদের একমাত্র অপরাধ, তাদের সন্তান অটিজম রোগে আক্রান্ত।

নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক অটিজম আক্রান্ত একজন শিশুর মা জানালেন তার করুণ অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, ‘ছেলের জন্মের সময় তার বাবা থাকতেন মধ্যপ্রাচ্যে। ওর জন্মের বছরখানেকের মধ্যে তার অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়ে আমাদের। আমরা জানতাম না অটিস্টিক শিশুর ব্যবহার কেমন হয়। এমনটা বেড়ে গেলে তাকে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার জানালেন, আমার সন্তান অটিজমে আক্রান্ত। এই কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ব্যাপারটি বাড়িতে জানাজানি হলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সবাই ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। কেউ ভালোভাবে কথাও বলে না। ওকে নিয়ে কোথাও গেলে সবাই হাসাহাসি করে। ওর কিছু আচরণ ছিল ভয়াবহ। খাবার খাওয়ার সময় আশপাশে যে থাকত তার দিকে খাবার নিক্ষেপ করত। কারণে-অকারণে সব শক্তি দিয়ে আমাদের আঘাত করত। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে থুথু দেয়। টিভি-ফ্রিজ-সোফা থেকে শুরু করে প্রায় সব জিনিসই সে ভেঙে ফেলত। লাফালাফি করা, ফ্লোরে শুয়ে পড়া, নিজেকে আঘাত করা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাসায় গেলেও সে সমানভাবে করে যেত তার এই আচরণ। যার ফলে মানুষের কাছ থেকে হয়েছি লজ্জিত আবার কখনও কখনও হতে হয়েছে অপমানিত। এভাবেই একাকিত্বে প্রতিনিয়ত চার দেয়ালের মধ্যে দুঃখে-কষ্টে কেটে যাচ্ছে আমাদের দিন। এতটা অবহেলার পাত্র হয়ে গেছি, কেউ কখনও জানার চেষ্টা করে না আমরা কেমন আছি।’

অথচ এটি শুধু মস্তিষ্কজনিত একটি রোগ। একদিকে অস্বাভাবিক সন্তানকে সামলানো, অন্যদিকে সমাজের করুণার দৃষ্টি, সব মিলিয়ে মায়েদের ভোগ করতে হয় তীব্র মানসিক যন্ত্রণা। অটিজম শিশুর মায়েদের সংগ্রাম করতে হয় তার পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, এমনকি নিজের সঙ্গেও। অটিজম সন্তানের মায়ের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার কথা আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়।

পুরো পৃথিবীতে এমন অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কম নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজ-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) ২০২২ সালের জরিপ মতে, দেশে প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত। 



অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া। শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অটিজম মূলত মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা। মূলত শিশু জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই বোঝা যায়, সে অটিজম আক্রান্ত কি না। সাধারণত প্রাথমিক বিকাশকালেই বাচ্চার অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। এতে সামাজিক সম্পর্কে সমস্যা, কথা বলার প্রতিবন্ধকতা এবং সীমাবদ্ধতা, পুনরাবৃত্তিমূলক ও একই ধরনের আচরণ দেখা যায়।’

অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা না গেলেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি অনেক কারণেই ঘটতে পারে। উল্লেখযোগ্য কারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের রোগ বা অসুস্থতা, পরিবারে অটিজম আছে এমন সদস্য থাকা, অপরিণত জন্মের কারণে শিশুর মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হয় না, জন্মগতভাবে কম ওজন ইত্যাদি।

অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্মের ১৮ থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে যদি সঠিক ও যথোপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, নিউট্রিশন থেরাপি বা পুষ্টি ব্যবস্থাপনা এবং প্রশিক্ষিত অটিজম থেরাপিস্টের মাধ্যমে থেরাপি প্রদান করা যায়, তাহলে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যেতে পারে। 

অটিজম শিশুর সমস্যার মাত্রা বুঝে সঠিক নিউট্রিশন থেরাপি বা খাদ্য ব্যবস্থাপনা দিলে কিছু আচরণগত সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমটি হলো কেমন খাবার দেওয়া যাবে এবং কেমন খাবার যাবে না। দ্বিতীয়টি পুষ্টির কথা মাথায় রেখে দিনে কয়েকবার খাবার দিতে হবে, কীভাবে দিতে হবে সর্বোপরি খাদ্যাভ্যাস গঠন।

বর্তমানে বাংলাদেশে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে অটিজম শিশুদের প্রশিক্ষণ দানে। তেমনই একটি সংস্থা সুইড বাংলাদেশ। এটি একটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে পুরো বাংলাদেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে ৫৪১টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম শিশুদের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সুইড ল্যাবরেটরি মডেল স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক শিম্মি সামাদ বলেন, বিশ্বজুড়ে অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ এ ব্যাপারে এখনও বেশ পিছিয়ে আছে। তার বড় একটি কারণ সামাজিক কুসংস্কার। অথচ প্রতিটি অটিজম শিশুর মধ্যেই থাকে আলাদা প্রতিভা, যা ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা। 

ভ্রান্ত ধারণা ও সামাজিক কুসংস্কার অটিজম সচেতনতায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জিল্লুর রহমান। অনেক সময় গ্রামাঞ্চলে অজ্ঞতাবশত অটিজম বাচ্চা সুস্থতায় এমনসব চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া হয় যার দ্বারা শিশুরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আরও বলেন, ‘অটিজম শিশু সমাজের অভিশাপ নয়, বরং তারা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু। তাই আমাদের উচিত তাদের যথাযথ যত্ন নেওয়া। বিশেষ করে এমতাবস্থায় মায়েদের ভেঙে না পড়ে নিজেদের মনোবল শক্ত করে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনার সন্তান যেমনই হোক তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা