উদ্যোক্তা
শাহ্ আলম শাহী
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩ ১২:১২ পিএম
ফেরদৌস-সাথী দম্পতির যৌথ উদ্যোগ ‘সুতার কাব্য’
সোনালি আঁশে দিন বদলের চেষ্টায় সফল দিনাজপুরে ফেরদৌস-সাথী দম্পতি। তাদের যৌথ উদ্যোগ ‘সুতার কাব্য’। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৭০ জন কর্মী।
ফেরদৌস-সাথীর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় পাটের সব জিনিসপত্র। যার মধ্যে রয়েছে পুতুল, ফ্লোর ম্যাট, প্লেস ম্যাট, ফ্লোর র্যাগ, টেবিল রানার, ব্যাগ, শতরঞ্জি, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট হ্যাঙ্গিং, প্ল্যান্ট বাস্কেট, লন্ড্রি বাস্কেট, টুল/ মোড়া, টয়েজ, মিরর, উডেন শো পিস, গ্লাস কোস্টার, কুশন কভার, এপ্লিক বেড কভার, পেন হোল্ডার, বুকমার্ক, গ্রেটিংস কার্ড, কি হোল্ডার, কিডস রাগ, টাফটিং রাগসহ নানা কারুপণ্য। দেশের চাহিদা মিটিয়ে যা রপ্তানি হচ্ছে দেশের বাইরেও।
দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে পার্বতীপুর সড়কের কোলঘেঁষে ১০ কাঠা জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচে পড়ার সুবাদে সিরাজুম মুনিরা সাথীর সঙ্গে পরিচয় ফেরদৌস আহমেদের। সময়টা ২০০০ সাল। দীর্ঘ আট বছরের পরিচয়-প্রেম সম্পর্ক থেকে ২০০৮ সালে বিয়ে হয় তাদের। বর্তমানে দুই মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।
ছাত্রজীবনে বাম ঘরানার রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন ফেরদৌস। পড়াশোনা শেষে ভিন্ন কিছু করে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করার ইচ্ছা ছিল তার। তবে জীবনের প্রয়োজনে চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হন। কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে সৃষ্টির উন্মাদনা। কাজের সূত্রে থিতু হন দিনাজপুরে। যদিও ফেরদৌসের গ্রামের বাড়ি যশোর আর সাথীর ঠাকুরগাঁওয়ে। সাথীর কর্মস্থল জেলা শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে রেল জংশনখ্যাত গ্রামীণ শহর পার্বতীপুরে। তিনি বেসরকারি একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। আর ফেরদৌস জেলা সদরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে রয়েছেন।
পেশাগত ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পরও ফেরদৌস-সাথী দম্পতি নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে সরে আসেননি। একপর্যায়ে তারা প্রক্রিয়াজাত পাটজাত দ্রব্য নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাশের জেলাগুলোয় খোঁজ নিতে শুরু করেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই এলাকাগুলোয় তাঁতের কাজ চালু থাকলেও নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় শাড়ি ও অন্যান্য সুলভ কাপড়ের দাপটে তাঁতশিল্প বিলীন হয়ে যায়।
এই কাজে আগ্রহী নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন। কিন্তু কাজটি তারা যতটা সহজ মনে করেছিলেন বাস্তবে সেটি তত সহজ ছিল না। সংসারের কাজ ফেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করার ব্যাপারে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও বোঝাতে হয়েছে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় অবশেষে তৈরি হয় কাজের উপযোগী পরিবেশ। রংপুর থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রথমে শ্রমিকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। একটু একটু করে এগোতে থাকে কাজ।
মাত্র ২০ জন নারী শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সালে শুরু হয় সুতার কাব্য। গ্রামীণ পরিবেশে এসব শৌখিন পণ্যের ক্রেতাও অপ্রতুল। তাই অনলাইনে পণ্যের কেনাবেচা শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে বাড়তে থাকে চাহিদা। বাড়ে ব্যবসার পরিধিও। গত বছর এসএমই মেলায় জিতেছেন শ্রেষ্ঠ পাটজাত পণ্যের স্টলের পুরস্কার। পাটের পাশাপাশি বাঁশপণ্য ও মাটির কারুশিল্প নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানুষগুলো, বিশেষ করে নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী তো হচ্ছেনই- পাশাপাশি সংসারেও যোগ করতে পারছেন বাড়তি রোজগার। নারী শ্রমিক মনিরা পারভীন জানালেন, তিনি ২ বছর ধরে কাজ করছেন। আগে বাড়িতে সাংসারিক কাজের বাইরে আর কোনো কাজ করা হতো না। সব খরচের জন্য স্বামীর রোজগারের ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে বর্তমানে নিজে মাসে ৭-৮ হাজার টাকায় আয় করেন। আয়ের টাকায় সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানোর পাশাপাশি প্রতি মাসে কিছু সঞ্চয়ও করেন।
সুতার কাব্যের স্বত্বাধিকারী সিরাজুম মুনিরা সাথী বলেন, পরিকল্পিত যাত্রা শুরু হলেও শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ২০১৭ সালে ২০ জন শ্রমিককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করি। বিশেষ করে নারীদের বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। এখনও যুদ্ধ করতে হচ্ছে।