কালো মানুষের আলো
আমিরুল আবেদিন
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩ ১২:০০ পিএম
মে জেমিসন
মহাকাশের গল্প শুনে শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন তিনিও যাবেন অন্তরীক্ষে। কিন্তু সমাজ-বাস্তবতা ছিল না পক্ষে। তবুও দমে যাননি তিনি। চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন নিবিড়ভাবে। অবশেষে হয়েছেন সফলও। মহাশূন্যে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন...
মে জেমিসনের জন্ম ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলাবামায়৷ ওই সময় এলাবামার অনেক আইন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের অনুকূলে ছিল না। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাঠমিস্ত্রি বাবা পরিবার নিয়ে দক্ষিণের শহর ইলিয়নয়ে চলে এলেন। জেমির মা স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মায়ের কাছেই তার প্রথম পাঠ।
১৯৬০-এর দশক মহাকাশযাত্রীদের জন্য রূপকথার সময়। এই দশকেই মানুষ পৃথিবী ছাড়িয়ে বাইরে অভিযাত্রা শুরু করে। ইউরি গ্যাগারিন আর এলান শেফার্ড মহাকাশ যাত্রা করেন। এই দশকের শেষেই নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন চাঁদে পা রাখেন। মর্ত্যের অধিবাসীর স্বপ্ন তাই আকাশ ছাড়িয়ে মহাশূন্যে। স্বপ্ন সীমাহীন হলেও মর্ত্যে থাকা শিকড়ের নাগপাশ কম নয়। আর কৃষ্ণাঙ্গ নারী হলে তো আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নটাই দুঃসাহস হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে বেসি কোলম্যান পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছেন কৃষাঙ্গ নারীও পারে।
শহরে থাকায় জেমির পক্ষে খোলা আকাশ দেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রতিবছর তারা সপরিবারে ক্যাম্প করতে যেতেন। প্রতিবার খোলা আকাশের নিচে অজস্র তারা দেখে মের কৌতূহলী মন বিজ্ঞানী হওয়ার ভাবনাটিকে নেড়েচেড়ে দেখেছিল। টিভিতে মহাকাশযাত্রার সফল ঘটনাগুলোও তাকে অন্তিম সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছিল। যদি সেও এভাবে কোনো দিন মহাকাশে যেতে পারে, তাহলে তাকেও টিভিতে দেখানো হবে। আর তখন সে সবাইকে স্বপ্নের পেছনে ছোটার কথা বলতে পারবে। এভাবেই প্রথম কৃষাঙ্গ নারী মহাকাশচারী তার জীবনের লক্ষ্যে থিতু হন।
ছোটবেলা থেকেই জেমিসন বিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। ওই সময় নারী বিজ্ঞানী বলতে নার্স বা ল্যাব সহকারীর স্বপ্নটাই ছোঁয়ার মতো। সবার স্বপ্ন তো সমাজ বুঝতে পারে না। যেমন- মে একদিন তার শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তরে জানায়, সে বিজ্ঞানী হতে চায়। শিক্ষক প্রথমবার ছোট মেয়েটির কথা বুঝতে পারেননি। তাই জিজ্ঞেস করেন, ‘বিজ্ঞানী মানে নার্স? বাহ! ভালো স্বপ্ন।’ কোনো পেশাই তুচ্ছ নয়। কিন্তু স্বপ্নের হিসাবে তুচ্ছের হিসাবের প্রয়োজন নেই। জেমি স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন, ‘না। আমি সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে চাই।’ বয়স কম, তাই মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্নটিকে এত জোর দিতে পারেননি। কিন্তু যে স্বপ্ন দেখে তার পথ হয়ে যায়।
তবে দুঃসাহসী এই স্বপ্নকে পরিচিত বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক এমনকি বাবা-মাও উৎসাহ দিতে পারেননি। কিন্তু জেমিসন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ডিগ্রি নিয়ে রিপ্রোডাকটিভ বায়োলজিতে গবেষণা শেষ করেন। এতদিনে একটি সফল ক্যারিয়ার তার হয়ে গেছে। কিন্তু আকাশ ছাড়ানোর স্বপ্ন তিনি ছাড়েননি।
লস অ্যাঞ্জেলসে এসে তিনি মহাকাশচারী হওয়ার আবেদন করেন। ১৯৮৮ সালে ২০০০ আবেদনকারীর মধ্যে যে ১৫ জন নির্বাচিত হন তাদের একজন মে জেমিসন। প্রচন্ড পরিশ্রমী মেকে স্পেসল্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের এক মিশনে মহাকাশে পাঠানো হয়। আর এভাবেই মে ইতিহাসে নিজের নাম গেঁথে নিলেন প্রথম কৃষাঙ্গ নারী মহাকাশচারী হিসেবে। এই সাফল্যের পর জেমি বহুবার বলেছেন, স্বপ্নবাজ গড়তে হলে ভালো বিদ্যালয় গড়তে হবে।
তার এই অর্জন কৃষাঙ্গ বহু নারীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যেমন অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে তার একটি উক্তি, ‘মানুষ আপনাকে একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে চলার পরামর্শ দিয়ে বাধাগ্রস্ত করবে। তাদের নিজস্ব কল্পনার জগৎ সংকীর্ণ বলে আপনার জগৎটাও ছোট করার প্রয়োজন নেই।’