হৈমন্তী শুক্লা
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৫০ পিএম
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৪ পিএম
বিকাল হতেই রাজধানীর লালমাটিয়া ডি ব্লকে ভিড় জমাতে থাকেন রিকশাচালক, দিনমজুর, খুদে ব্যবসায়ী, ভিখারিসহ হতদরিদ্র মানুষ। রাস্তার দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যান। এখানে তাদের একটাই পরিচয়- মেহমানখানার মেহমান।
প্রায়ই এখানে আসেন রিকশাচালক নজির ইসলাম। রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তার থেকে ইফতার করলে খরচ হয়ে যায় অনেক টাকা। নিত্যপণ্যের চড়া দামের এই বাজারে সারা দিন রোজা রাখার পর পেটভরে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াও যেন বিলাসিতা। তাই সুযোগ পেলেই ইফতারের আগে ছুটে আসেন মেহমানখানায়। নজির ইসলামের মতো হাজারো মেহনতি মানুষের ইফতারের ভরসা এখন মেহমানখানা। তিনি বলেন, ‘গরিব মানুষ যারা তাদের তো কিছু নাই। জায়গায় জায়গায় এমন আয়োজন করলে খুব ভালো হয়। আমরা দিনমজুর খাইট্টা খাই। আমরা তো চাইয়া খাইতে পারি না। মেহমানখানা আমাগো জন্য অনেক কিছু করতাছে।’
প্রতিদিনই মেহমানের সংখ্যা বাড়ছে। আপ্যায়নে ক্লান্তিহীন ছুটে চলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। খাবারের তালিকায় থাকে খিচুড়ি, মুড়ি, কলা, খেজুর, শরবত। কোনো কোনো দিন অবশ্য স্বাদে ভিন্নতা আনতে পরিবর্তন করা হয় মেন্যু।
দিনভর ভিক্ষে করে যা জোটে, তা দিয়ে সংসার চলে না কুসুমের। তার ওপর নিত্যপণ্যের চড়া দাম। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়েই ইফতার করতে ছুটে আসেন মেহমানখানায়। খেয়ে যান, খাবার বেশি থাকলে সেহরির জন্য নিয়েও যান। কুসুম বলেন, ‘আমি ডেইলিই এহানে খাই। কয়েক বছর ধইরা খাওয়াইতেছে তারা। খাইয়া একটা শান্তি পাই। ঘরে তো এত জিনিস তৈয়ার কইরা খাইতেও পারি না। ঘরে থাকলে পানি, পান্তাভাত খাইয়া রোজা খুইল্লা নামাজ পড়ি। এইহানে আইয়া বেইন্নাহালে খাওয়ার খাওনডা নিয়াও যাই।’
আয়োজকরা জানান, প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মানুষের সাহায্যে আর স্বেচ্ছাসেবীদের চেষ্টাতেই চলে নিরন্নদের অন্নের জোগান। স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকে সকাল থাকে রাত পর্যন্ত এখানে কাজ করেন। অসহায়দের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আনন্দে ভুলে যান সারা দিনের ক্লান্তি। এমনই একজন জেসমিন। এত কষ্টের পরও কেন এখানে ছুটে এসে স্বেচ্ছাশ্রম দেনÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত এখানে খাটি। এটা আমি ভালোবাসি। আমি চাই যে প্রত্যেকটা মানুষ ঠিক টাইমে ইফতারি করুক। কারও যেন ইফতার না করে এখান থেকে যাওয়া না লাগে। অন্তত একটা খেজুর হলেও যেন খেতে পারেন। অসহায় মানুষেরে নিজ হাতে খাওয়ানো কত আনন্দের, সে অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। রাতে ঘরে ফিরে আমার ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় না। বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে যাই। এটা এখানের এই আনন্দ নিই বলেই সম্ভব।’
২০২০ সাল থেকে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবারের আয়োজন করে আসছে সংগঠনটি। প্রতি শুক্রবারই হয় আয়োজন। তবে রোজার সময় মাসজুড়েই থাকে ইফতার আয়োজন। এ কাজের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের সামর্থ্যমতো পাশে দাঁড়াচ্ছে।
মেহমানখানার প্রধান উদ্যোক্তা আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘এখনও সমাজে অনেক ভালো মানুষ আছেন। যারা খুব নীরবে মেহমানখানায় চাল-ডাল-পেঁয়াজ দিয়ে যান। কেউ বা স্বেচ্ছায় শ্রম দেন। এটা আসলে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমাদের মানবিক মূল্যবোধ। যারা নিয়মিত এখানে খেতে আসেন তাদেরও অনেকে এখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। সবার অংশগ্রহণেই উদ্যোগটি চলছে।’
আসমা আক্তার লিজার দাবি, এর পরও কিছু মানুষ মেহমানখানা বন্ধ করার জন্য তৎপর। তাদেরও এখানে আসার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন সমাজে সাহায্য-সহযোগিতা করা ও সমবেদনা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। মেহমানখানা তেমনই এক মানবিক সংগঠন। এমন মহৎ উদ্যোগে চাইলে আপনিও পাশে থাকতে পারেন।