× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তৃতীয় লিঙ্গের জীবন যেমন

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫০ পিএম

আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৫:০৫ পিএম

হিজড়া একটি সংস্কৃতির নাম। বহুদিন ধরে হয়ে আসা পরম্পরার নাম হিজড়া                                          ছবি : শাহরিয়া শারমীন

হিজড়া একটি সংস্কৃতির নাম। বহুদিন ধরে হয়ে আসা পরম্পরার নাম হিজড়া ছবি : শাহরিয়া শারমীন

এই মানুষগুলোকে অনেকে ডাকেন ‘হিজড়া’। কেউবা বলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাদের দেখা যায় পথে-ঘাটে, রাস্তায়। লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে সমাজের চোখে আলাদা এই মানুষদের জীবন-যাপন, চলন-বলন এবং  অর্থনৈতিক অবলম্বনও ভিন্ন। অধিকারহারা এই গোষ্ঠীর জীবন নিয়ে লেখা.... 

চিলেকোঠার ছাদে বসে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ এলাকার গুরুমা আনুড়ি হিজড়া। ছাদটি খুব পরিপাটি করে সাজানো, আছে হরেকরকমের গাছ। দেখলে মনে হবে অনেক যত্ন করে ঘর গুছানো হয়েছে, কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভুল ধরারও সুযোগ নেই। প্রতিদিন এখান থেকে হিজড়াদের দুটি দল কাজে বের হয়। তার অধীনে থাকেন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন হিজড়া। এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। তবে তারা যে যে ধর্মের, সে সেই ধর্ম পালন করে। 

পরিপাটি ছাদ দেখে জানতে চাইলে বলেন, ‘রোজা শুরু হচ্ছে নামাজ পড়ব, মসজিদে জায়গা হবে না।’ ঠাট্টা করে বললেন, ‘আমি মসজিদে গেলে পুণ্য করতে গিয়ে পাপ হয়ে যাবে।’ হিজড়া জনগোষ্ঠীর উন্নতি চান এই গুরুমা। তবে নিজেদের ২০০ বছরের সংস্কৃতিকে হারাতে চান না। পরম্পরায় হয়ে আসা এই প্রথাকে ধরে রাখতে চান। 

বাসে কিংবা ট্রেনে হিজড়াদের দেখা গেলেও ঐতিহ্যগতভাবে তারা মূলত তিনটি কাজ করে। অমায়িক হেসে অনুরোধের সুরে বললেন, বাসে-ট্রেনে যখন তখন চাঁদা তোলার পক্ষপাতি নন তিনি। ছল্লাহ, বাধাই, ঢোল-মূলত এই তিনটিই তাদের আদিপেশা। ‘ছল্লাহ’ হলো প্রতি সপ্তাহে একবার দোকান থেকে টাকা তোলা, বাধাই  হলো কোথাও বিয়েবাড়িতে নাচ-গান-আনন্দ করে টাকা তোলা ও ঢোল বলা হয় বাচ্চা নাচানোকে বা কোনো পরিবারে নতুন কোনো শিশু জন্মালে সেখান থেকে টাকা তোলা। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জনের একটি দল কাজে যায়, ফিরে আসে বিকেলের মধ্যেই। কে কোন দলে যাবেন তা ঠিক করে দেন গুরু মা। প্রতিটি জায়গায় তাদের এলাকায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গুরু।

পরিবার ও সমাজচ্যুত হওয়ার পর শেষ আশ্রয় তাদের গুরু মা। আশ্রয়দাত্রী এ মাও একদিন ঘর হারা হয়েছিলেন মাত্র ১১ বছর বয়সে। শিশুদের একমাত্র আশ্রয় বাবা-মা হলেও হিজড়াদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। চলন-বলন দেখে জন্মদাতা বাবাই ঘর থেকে তাড়িয়ে দেন তাকে। পড়াশুনার গণ্ডিটাও প্রথম শ্রেণির পর আর পেরোতে পারেননি। স্কুলে নানারকম কটাক্ষের শিকার হতে হতো। সব হারিয়ে তিনিও গুরুমার কাছে আসেন। ৩৫ বছর ধরে আছেন যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জের এ এলাকায়।


আনুড়ির মতো ঘর ছেড়েছিলেন মিতু হিজড়া। ১৮ বছর বয়সী মানুষটি হিজড়া অধিকারে  সোচ্চার সংগঠন সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে (বন্ধু) কাজ শুরু করেন। এখন পদ্মকুড়ি সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে হিজড়াদের প্রশিক্ষণ ও তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করছে। মা মারা যাওয়ার পর বাড়ি ছাড়তে হয়। মিতু জানান, ‘মা বলত, আমার সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে বা অন্যকিছু আমারই। একসময় মা মারা গেলে আগলে রাখার আর কেউ ছিল না। অন্য ভাইটা যেভাবে যত্নে ও আদরে থাকে, সে জায়গা আমার হয়নি।’

কুর্তি, প্যান্ট পরা সাদাসিধা সাজের এই মানুষটিকে দেখলে বেশিরভাগ মানুষের চিন্তার জগতে হিজড়াদের থাকা সেই চিত্র মেলানো কঠিন। মিতু বলছিলেন, হিজড়া মানেই মানুষ ভাবে শাড়ি, চুড়ি পরা কিংবা ভারী মেকআপের কেউ। হিজড়াদের নিয়ে ট্যাবুগুলো এখনও প্রচলিত রয়েছে এ দেশেই। আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা তাদের মতো করে পোশাক পরেন, পছন্দের কাজ করেন। 

হিজড়ারা এগিয়ে যেতে চাইলেও তাদের সম্পর্কে ধারণাকে বাদ দিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। ২০১২ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে হিজড়া জাতির মান-উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ১১ বছরে এ প্রকল্পের পেছনে ৭০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বলে জানায় অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে হিজড়াদের মানোন্নয়নের কাজ শুরু করে অধিদপ্তর। হিজড়া ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ ও পরিচয়পত্র প্রদান; ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের দুস্থ ও অসচ্ছল হিজড়া ব্যক্তিকে মাসিক ৬০০ টাকা হারে বিশেষ ভাতা প্রদান করা হয়। হিজড়া শিক্ষার্থীদের মাসিক হারে প্রাথমিক স্তরে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এক হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে এক হাজার ২০০ টাকা হারে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান; কর্মক্ষম হিজড়া ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান, আর্থিক অনুদান প্রদান ও আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিতকরণ; প্রশিক্ষণোত্তর এককালীন নগদ সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।

তবুও কেন এ জাতিগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না? বিভ্রান্তি আছে তাদের লিঙ্গ ও জাতিগত সংজ্ঞায়ও। ২০১৪ সালে হিজড়াকে লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সরকারিভাবে, যা আশারবাণী নিয়ে এলেও  প্রত্যাশাকে পূরণ করেনি। মিতু  জানান, হিজড়া কোনো লিঙ্গ না। এটা মূলত তারাই, যারা হিজড়াগিরী বা আমাদের আদি পেশার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু যারা এ কাজ করে না তারা হিজড়া নয়। মূলত আমরা সবাই-ই ট্রান্সজেন্ডার।

এ কথার সঙ্গে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদ নাসরীন। দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বলেন, ‘হিজড়া একটি সংস্কৃতির নাম। বহুদিন ধরে হয়ে আসা পরম্পরার নাম হিজড়া। মূলত যারা একটা সময় নিজের পরিবর্তন বুঝতে পারেন, তাদের মধ্যে কেউ ট্রান্স ম্যান বা ট্রান্স উইমেন। 


এ বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি বলে জানান সঞ্জীবনী সুধা। তিনি বলেন, প্রত্যেকটা হিজড়াই ট্রান্সজেন্ডার। এই জায়গাটি কেউ ধরতে পারে না। হিজড়া শব্দগতভাবে আলাদা। এটা তো একটা লাইফলং প্রসেস। স্বাধীনতার পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের ভেতরেও আমার মতো মানুষ জন্মেছে। কিন্তু সচেতন ছিল না, ওয়াকিবহাল ছিল না বলে বিষয়গুলো সামনে আসেনি। এখন বিভিন্ন চিন্তা করা হচ্ছে জেন্ডার নিয়ে। ২০১৯ সাল থেকে বলা যায় বাংলাদেশে জেন্ডার নিয়ে খুব আলোচনা শুরু হয়েছে। এ সম্প্রদায়ের মানুষগুলো পড়াশুনা করতে পারে না, তাদের সেভাবে গ্রুমিং করা হয় না। তাই শুধু কিছু বিষয় দিয়ে জেন্ডার আইডেন্টিফাই করার বিষয়টি সংকুচিত। 

বাংলাদেশে হিজড়াদের অবস্থা কী?

বর্তমানে সাদা-কালো ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছেন অরুভী হিজড়া। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। হাতের কাজ ভালোবাসলেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সেলাইয়ের ওপর। প্রশিক্ষণ-উত্তর ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। তারপর চার মাস কেটে যায় তবুও কাজে সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। খাওয়া পরার টাকা নেই একদিকে, অন্যদিকে হিজড়া বলে কেউ কাজ দিচ্ছে না। অরুভী জানান, ‘শুরুতে কাজ পাইনি। পরে বঙ্গঘরা ফাউন্ডেশনে কাজ শুরু করি। তারপর সাদা-কালোতে কাজ করি। স্বল্প বেতন হলেও আত্মসম্মান আছে। চাকরির পাশাপাশি নিজে কিছু করি, তবে সেসব বিক্রি করতে গেলেই পরিচয় সংকট হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আর্থিক সংকট এখনও অনেক। একটা ছোট্ট দোকান দিতে চেয়েছিলাম। নিজে দাঁড়াতে পারলে আরও অনেককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করতে পারব।’ কিন্তু অরুভীরই দিন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। 

তবে ইচ্ছাশক্তি অনেক বড় বিষয় বলছিলেন ব্লাস্টের শোভা সরকার। পরিবার থেকে শোভাকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে মেনে নিলেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির অপমান এড়াতে পারেননি তিনি। রান্নায় পারদর্শী শোভা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ট্রেনিং সেন্টারে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তবে প্রতিষ্ঠানের আপত্তি না থাকলেও বাইরের মানুষের কটাক্ষে বিরক্ত হয়ে মহাজন তাকে তাড়িয়ে দেন। তারপর বিভিন্ন জায়গা থেকে সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন ‘উত্তরণ ফুড কর্নার’। সেখানে তার অধীনে অনেকে কর্মরত আছেন এখন। শুধু তা-ই নয়, অন্যদের মতো নিজের পরিবারের প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। 

অরুভী বলেন, ‘প্রশিক্ষণে আমাদের শুধু কাজ শেখানো হয় না, গ্রুমিংও হয়। তবে প্রশিক্ষণের পর যে টাকা দেওয়া হয় তারপর ছেড়ে না দিয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ বাইরের জগতে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কম। আর্থিক কোনো যোগসূত্র থাকে না। বাসা ভাড়া থাকে না।

গুলশানে একটি বায়িং হাউসে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন সাঞ্জু হিজড়া। নিয়ম অনুযায়ী কোনো হাউসে ১০ শতাংশ বা ১০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিলে সে প্রতিষ্ঠানকে সরকারিভাবে ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ দেখাচ্ছে তাদের কাজে যুক্ত করতে। কিন্তু তারপর কী হয়? সাঞ্জু বলেন, ‘অফিসে ভালো করে কথা বলত না। ছেলেরা যেভাবে দাঁড়াত আমাদেরও সেভাবে দাঁড়াতে বাধ্য করা হতো। একটা সময় চাকরি ছেড়ে দিলাম। অনাদরে বড় হওয়া আমরা একটু স্বাধীনচেতা, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই।’

দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কতজন?

শেষ জনশুমারিতে বলা হয়েছে ১২ হাজার ৬২৯ জন হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলোদেশে রয়েছে। এ জরিপ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। হিজড়া নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনসহ হিজড়াদের মানোন্নয়নে যারা যুক্ত আছেন, তারা এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন। পদ্মকুড়ির মিতু হিজড়া বলেন, ‘জরিপ করার সময় সাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে হিজড়াদের কাউকেও রাখা উচিত ছিল। অনেকেই সমাজের ভয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখবে, অনেকে লজ্জা পাবে। এতে করে সঠিক পরিসংখ্যান উঠে আসবে না। সংখ্যাটা আরও দ্বিগুণ হবে। পরিবার থেকে বলবে না আমার ঘরে হিজড়া আছে।’ 

সঞ্জীবনী বলেন, আগে সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। সেই আলোচনা আবার সাধারণ মানুষ মন থেকে গ্রহণ করবে কি না তাও নিশ্চত করতে হবে। কারণ তারা গ্রহণ করতে না পারলে হিজড়ারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। ব্যাংকে চাকরির সময় প্রতিষ্ঠান হয়তো আমাকে সে পরিবেশ দিয়েছে, কিন্তু যখন বাইরের কেউ আসছে, তারা আমাকে কখনও কখনও নিতে পারছেন না। তাই আগে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা