কালো মানুষের আলো
আমিরুল আবেদিন
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:২৪ পিএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:২৮ পিএম
বেসি কোলম্যান
আজ থেকে ১০০ বছর আগে বেসি কোলম্যান ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটি খোদাই করে ফেলেন। কারণ, প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে বিমান চালানোর লাইসেন্স পেয়েছিলেন তিনি। তবে আকাশে ওড়ার জীবনটা দীর্ঘ হয়নি এক মর্মন্তুদ দুর্ঘটনায়।
কে ভেবেছিল, ভাইয়ের সামান্য ঠাট্টা থেকে বিমান চালানোর জেদটা তিনি ধরে রাখবেন এবং সফলও হবেন? টেক্সাসের ওয়াক্সাহাচিতে এক ছোট খামারে বেসি কোলম্যানের জন্ম। বেসি বাদেও আরও ১৩ সন্তান ওই ছোট খামারে বেড়ে উঠছিল। এক সময় উত্তর শিকাগোতে অভিবাসনের ধুম পড়লে বেসি ১৯১৫ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন। এ সময় শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বেসির ভাই জন যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের মাঝে একবার জন বাড়িতে ফেরে। ফিরেই বোনকে লক্ষ করে বলে, ফ্রান্সে মেয়েদের বিমান চালানোর লাইসেন্স দিচ্ছে। আমার বোনকে দিয়ে ওসব তো আর হবে না। একে কালো, তায় আমেরিকান। এ কথা শুনে বেসি বেজায় চটেছিলেন। তবে জেদ সব সময় কাজে আসে না। আমেরিকাতেই বেসি পাইলটের লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রথমবারই তাকে নাকচ করে দেয়।
বেসি বুঝতে পেরেছিলেন, আমেরিকায় চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। অগত্যা কয়েক মাসে ফরাসি ভাষা রপ্ত করে নেন। ভাষা রপ্ত হতেই পাড়ি জমান ফ্রান্সে। ফ্রান্সে পাড়ি জমানোর পর তিনি পরিবার বা অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল থাকেননি। সেখানে বিউটিশিয়ান ও ম্যানিকিউরিস্টের কাজ শুরু করেন। বিউটিশিয়ানের কাজ করে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত হয়। ফ্রান্সের কড্রন ব্রাদার অ্যাভিয়েশন স্কুল বেসি কোলম্যানের আবেদন গ্রহণ করে। অবশেষে ১৯২১ সালের ১৫ জুন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বিমান চালানোর লাইসেন্স পান তিনি। কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা এটি।
নিজের একটি বিমান হবে এবং বিমান প্রশিক্ষণের স্কুল খুলবেন- এমন একটি ভাবনা তার মনে। সে জন্য বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছেন, লিখেছেন- এমনকি ওই সময় অনেক নারীকে উদ্বুদ্ধও করেছেন নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশেষে ১৯২২ সালে বেসি কোলম্যান তার প্রথম বিমান ভ্রমণ করেন। তিনি লুপ-দ্য-লুপ পারমরম্যান্সের জন্য দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে খ্যাতিলাভ করেন। ইংরেজি আটের শেপে আকাশে বিমান চালানোর এই দক্ষতা মাটিতে দাঁড়ানো মানুষদের মুগ্ধ করত। বেসি এবার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সবখানেই তিনি ফ্লাইট শো করেন। তবে কোথাও কৃষ্ণাঙ্গদের বৈষম্য করা হয় এমন জায়গায় ভুলেও যান না। নিজের দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণের জন্য অর্থ জোগাড় করছিলেন, তবে আত্মসম্মানবোধ হারাননি।
বেসির স্বপ্নটা পূরণ হতো, যদি না এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করতেন। বিমান দুর্ঘটনা তার জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও একবার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। সুস্থ হওয়ার পরই বেপরোয়া ফ্লাইট টেকনিক দেখিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করেছেন। ১৯২৬ সালের ৩০ এপ্রিল বেসি কোলম্যান উইলিয়াম উইলসের সঙ্গে তার বিমানের টেস্ট ফ্লাইট শুরু করেন। তখনকার দিনে বিমানের কোনো ছাদ ছিল না। পাইলটরা সিটবেল্ট দিয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখতেন। বেসির বিমানে একটি রেঞ্চ খুলে গিয়ে ইঞ্জিনে আটকে যায়। তখন বিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ফিট ওপরে। ইঞ্জিনের গণ্ডগোলে বিমানটি শূন্যে উলটে যায়। বেসি সিটবেল্ট বাঁধতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই বিমান থেকে তিনি ছিটকে পড়েন এবং এভাবেই তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে গোটা আমেরিকা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তার শেষকৃত্যে হাজার মানুষের শোকার্ত ঢল নামে। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের স্বপ্নপূরণে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। কিন্তু বেসির অনুপ্রেরণা আজও রয়ে গেছে।