রহিম শুভ
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:০৯ পিএম
তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন
ঠাকুরগাঁও সদরের বরগাঁও ইউনিয়নের কিসমত কেশুরবাড়ি গ্রামে কান পাতলেই শোনা যায় তাঁতের খটখট শব্দ। দিন-রাত শীতের কম্বল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতি পরিবারের সদস্যরা।
প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় কারিগররা নিপুণ হাতে বুনে চলেছেন কম্বল। প্রতিটি বাড়িতেই দুই থেকে ছয়টি পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। এর কোনোটা চাকাওয়ালা, আবার কোনোটা একেবারেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি। সকাল থেকেই বাড়ির নারী-পুরুষসহ সবাই লেগে পড়েন কম্বল তৈরির কাজে।
তবে তাঁতপল্লীর অনেক পরিবার এই পেশা বাদ দিয়ে বিভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন। এর মূল কারণ সুতার দাম বেশি। ভালো সুতা পাওয়া যায় না। আবার গাড়ি ভাড়াও বেড়ে গিয়েছে। কম দামে এখন বাজারে বেলজার পাওয়া যায়। তাই কম্বলের চাহিদা কম। বাজারে আর আগের মতো তেমন বিক্রি হয় না কম্বল। তাই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে অনেক পরিবার বিভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছে।
দুলাল দাসে নামে এক তাঁতশিল্পী বলেন, এটা হামার বাপ-দাদা করত, তাই হামরাও ধরে আছি। আগের মতো পত্তা পড়ে না। সবকিছুর দাম বেশি- সুতার দাম, গাড়ি ভাড়া ডাবল। ভালো সুতা পাওয়া যায় না। সুতা আনতে বগুড়া যাওয়ার লাগে। আগে গাড়ি ভাড়া ছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা, এখন গাড়ি ভাড়া প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। হামার পোষায় না। তাও ধরে আছি এই পেশা।
কিনিশি কান্ত দেবনাথ নামে একজন বলেন, এটা আমার দাদা-বাবা এ কাজ করে এসেছেন। তাই আমিও করছি। কম্বল তৈরির সুতা বগুড়া থেকে আনতে হয়। এতে ভাড়া বেশি পড়ে। পড়তা হয় না। আগে সরকারিভাবে আমাদের এই কম্বল কেনা হতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে আর সরকার কিনছে না। কারণ বাজারে এর থেকে কম দামে বেলজার কম্বল পাওয়া যায়। তবে বেলজার কম্বল বেশিদিন লাস্টিং করে না। সরকার যদি আবার কেনে, তাহলে আমরা যে ক’জন এই পেশা ধরে আছি- তারা এটা করে সংসার চালাতে পারব।
বিমলা দেব নাথ নামে এক নারী বলেন, আমি আর আমার স্বামী মিলে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কম্বল বানাই। প্রতিদিন ৯ থেকে ১০টা কম্বল বানাতে পারি, যার বাজারমূল্য ১৮শ টাকা। সুতার দাম বেশি হওয়ায় এখন আগের মতো পোষায় আমাদের। টেনেটুনে সংসার চলে। শ্বশুরের পেশা ছাড়তেও পারি না।
রঞ্জিত দেব নাথে একজন বলেন, শীত এলে আমাদের সিজন শুরু হয়। শীত শেষ হলে আর কম্বল বানাই না। শীতের সময় কম্বল চলে। শহরে এই কম্বলের দাম বেশি হলেও গ্রামে এই কম্বলের দাম কম। বৌ-ছেলেমেয়ে সবাই মিলে বানাই দেখে একটু পড়তা হয়, না হলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করছে। আস্তে আস্তে তাঁতশিল্প ধ্বংসের মুখে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
অনুকূল দেব নাথ নামে আরেকজন বলেন, আমার দুই ছেলেমেয়ের বড়টা ইন্টারে পড়ে আর ছোট ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবা এই কাজটা শিখাইছে শুধু, আর অন্য কোনো কাজ করতে পারি না আমি। এই কাজ করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ আর সংসারে খরচ চালাতে আমাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। সরকার যদি কম সুদে আমাদের লোনের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে অনেক ভালো হয়।
পাইকার সিবলু দাস বলেন, আগে বাজারে কম্বলের চাহিদা ছিল অনেক। নিয়ে গেলে ১৫ থেকে ২০ পিস কম্বল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ধরে বিক্রি হতো। এখন ২০০ টাকায়ও কিনতে চায় না কেউ। বাজারে বেলজার ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় পাওয়া যায়। এস সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এ ব্যবসা ধরে আছি। এখন ৫ থেকে ৭টা বিক্রি হয়। তাও ২শ টাকা করে। কোনোমতে সংসার চলে।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণাংশ দত্ত টিটো বলেন, তাঁতশিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ পেশা ধরে রাখতে হলে তাঁতিদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দরকার। সরকারেরর পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করব তাদেরকে সহযোগিতা করার। আমি মনে করি, সরকারি সহযোগিতা পেলে তাঁতি পরিবারগুলো তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। এই পেশা বিলুপ্ত হবে না।