× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

২৫ মার্চ- প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে

দুঃসহ সেই রাতের কথা

আমির হোসেন

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩ ১৩:০৫ পিএম

দুঃসহ সেই রাতের কথা

১৯৭১ সাল। স্মৃতিপটে ভাসে যুদ্ধদিনের উত্তাল সময়ের হাজারো মুহূর্ত। তখন আমি জগন্নাথ কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পুরান ঢাকার রথখোলার কাছে টিপু সুলতান রোডের গোয়ালঘাট লেনে এক পরিচিতের বাসায় থাকতাম।

মার্চজুড়েই ঢাকা ছিল মিটিং-মিছিলের নগরী। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে শামিল হতাম মিছিলে। পুরানা পল্টনে লাঠি হাতে নিয়ে ট্রেনিং করতাম আমরা। 

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে বুঝতে পেরেছিলাম যুদ্ধ আসন্ন। কারণ পাকিস্তানিরা এত সহজে ছাড় দেবে না আমাদের। আমরাও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তারা এভাবে কাপুরুষোচিতভবে নৃশংস আক্রমণ করবে ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি।

২৫ মার্চ বিকালনাগাদ ব্যক্তিগত কাজে পল্টন এলাকায় গিয়েছিলাম।  সেখানে গিয়ে হঠাৎ শুনতে পাই সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সবাই প্রাণপণে দিগবিদিক ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। আমিও পল্টন থেকে পুরান ঢাকায় ফিরি হেঁটে-দৌড়ে। বাতাসে গুজব, আর্মি নামবে শহরে। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো শহরজুড়ে।

রাত তখন আনুমানিক ১২টা। হঠাৎ প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কী হচ্ছে। ক্রমেই আওয়াজ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মানুষের আহাজারি। আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছিল। বুঝতে আর বাকি থাকে না পাকিস্তানি আর্মিরা আক্রমণ করেছে নিরস্ত্র মানুষের ওপর।

আমির হোসেন

যে বাসায় থাকতাম সেটা ছিল একটা গলির ভেতর। সামনের রাস্তা দিয়ে আর্মিরা গুলি করতে করতে আর আগুন দিতে দিতে গেলেও আমাদের গলির ভেতর ঢোকেনি বলে সে যাত্রায় রক্ষা পাই আমরা। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম। গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদের মাঝেই রাতটা কাটে। ভোর হতে হতে কমে আসে শব্দ। ঘর থেকে বেরোব কি না ভাবছিলাম। আমার মেজো মামা থাকেন সদরঘাট, তার খোঁজ নিতে হবে। খোঁজ নিতে হবে আমার বন্ধুদের, পরিচিতজনদের। মাথায় তখন হাজারো ভাবনা। সকাল ৭টা নাগাদ বেরোই। পরিস্থিতি তখন কিছুটা শান্ত।

পরিস্থিতি শান্ত হলেও রাস্তায় নেমে দেখি রাতজুড়ে পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। আগুন জ্বলছে চারদিকে। ঘর ছেড়ে অনেকে বের হয়েছে তখন। যে যেদিকে পারে ছুটছে। রাস্তায় রাস্তায় মৃত মানুষ। কারও হাত নেই, পা নেই, কারও নেই শরীরের অর্ধেক অংশ। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেককে। এসব দেখতে দেখতে কলেজের দিকে যাই। সেখানে গিয়েও দেখি একই চিত্র। কলেজের গেটের কাছে একটা লাশ পড়ে আছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি মানুষটা আমার পরিচিত। আমাদের কলেজ গেটের কাছে বসে ভিক্ষা করতেন। তার দেহের নিচের অংশ নেই। কোমর থেকে বুকের অংশটুকু আগুনে ঝলসানো। শুধু মুখের অংশটুকু পোড়েনি। তার মতো এমন শত শত লাশ রাস্তায়। এসব দৃশ্য দেখে তখন পাগলপ্রায় অবস্থা আমার।

আমি সদরঘাটের দিকে যাই মামার খোঁজে। তাকে অক্ষত অবস্থায় পাই। তাদের বাসায়ও আক্রমণ করতে পারেনি পাকিস্তানি সেনারা। গিয়ে দেখি মামাও আমার জন্য চিন্তিত। দুজন দুজনকে দেখে শান্তি অনুভব করলাম। আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, পাকিস্তানিরা সব শেষ করে দিল। এরপর মামা তাড়া দিলেন বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য। গ্রামে ফিরতে হবে আমাদের। রাস্তায় সারি সারি মৃতদেহ আর আগুনের মধ্য দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। 

আমার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায়। বাড়িতে মা আর ছোট দুই ভাই-বোন। বাবা কর্মসূত্রে দেশের বাইরে। চারদিকে চাপা উত্তেজনা আবারও আর্মি নামবে শহরে। শুনতে পাই শেখ মুজিবকেও নাকি ধরে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন প্রান্তেও নাকি আর্মিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। হাজারো মানুষ হত্যা করেছে। এ সময় ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ হবে না। মামার এক বন্ধু তার গাড়ি নিয়ে আমাদের কয়েকজনকে ঢাকার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দেন। এরপর হাজারো ঘরছাড়া মানুষের সঙ্গে প্রায় দেড় দিন হেঁটে নোয়াখালী পৌঁছাই। যুদ্ধদিনের হাজারো স্মৃতির মাঝে ২৫ মার্চের সেই কালরাতের কথা কখনও ভুলতে পারিনি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা