২৫ মার্চ- প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে
নাজমা কবির
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩ ১৩:০০ পিএম
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের সবারই একই রকম। তখন আমরা ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে থাকতাম। বাড়ির দোতলার ছাদে নতুন একটা পতাকা টাঙানো হয়েছিল। পতাকাটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার পরপরই বানানো হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার জন্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পতাকাটি আমাদের বাড়ির অসম্পূর্ণ দোতলার ছাদের একটি লোহার রডে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সবুজ পতাকা, মাঝে লাল সূর্য আর সূর্যের মাঝে একটি মানচিত্র। নতুন বাংলাদেশের মানচিত্র।
সেই পঁচিশের রাতে, সাড়ে এগারো বা বারোটার দিকে যখন গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বাবাকে চিন্তিত দেখলাম, মাকে অস্থির দেখলাম। ভাই বাড়ি নেই। চারদিকে বেশ শোরগোল, ট্যাংক, গুলির শব্দ যেন নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে।
রাত যত গভীর হচ্ছে ততই যেন বুকের মধ্যে অশান্তির কাঁপুনিটা বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়িটা ছিল। বেশ কটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। কতক্ষণ বেশ চুপচাপ। হঠাৎ বাড়ির ভেতরের দরজায় ধাক্কা। কারা যেন ভেতরে আসতে চাইছে। বাবা সন্তর্পণে দরজা খুললেন। চার-পাঁচ জন মাঝবয়সি লোক ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিন। বাইরে মিলিটারি।’ তারপর একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলে আসেনি?’ বাবা বললেন, ‘কোথায় গেছে সে আমরা তো কিছুই জানি না।’ মা ভাইয়ের কথা শুনে কান্না শুরু করলেন।
এরই মধ্যে বাইরে মাইকে কারা যেন পতাকা নামানোর নির্দেশ দিচ্ছে, নয়তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। ভাই বাড়িতে নেই, কে নামাবে? সিঁড়িও নেই, এত রাতে কীভাবে ওই ইট বেয়ে ওপরে কে উঠবে? বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন পারব কি না। সাহস নিয়ে বললাম, পারব। ওপরে উঠে দেখি চারদিকে আগুনের লেলিহান। তখন ধানমন্ডিতে উঁচু দালান খুব কমই ছিল। তাই অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেলাম। মনে হলো তেজগাঁও বিমানবন্দর, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, আজিমপুর, পিলখানা, ইউনিভার্সিটির হল–সব জায়গায় আগুন জ্বলছে। আগুনের বলের মতো কীসব মাথার ওপর এক দিক থেকে অন্য দিকে ছুটে যাচ্ছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে পতাকাটি খুলে নিয়ে নিচে এলাম।
কারও চোখে ঘুম নেই। ভোর হয়ে আসছে। ঘুমের ভাবটা চোখে লেগে এসেছে, তখন শুনি কে যেন জানালার ফাঁক দিয়ে চাপা স্বরে ডাকছে, ‘মা, মা’। মা দৌড়ে গেলেন; আর কেউ নয়, তার একমাত্র ছেলে। সঙ্গে তার দু-তিন জন বন্ধু। শরীরে কাদা মাখা, লাল চোখ। ভীষণ ক্লান্ত। অনেক প্রশ্ন। ‘কোথায় ছিলি? এই অবস্থা কেন তোদের? কী হচ্ছে বাইরে? তোরা কি কিছু জানিস?’ ধীরে ধীরে তাদের মুখে সব শুনে সবাই স্তব্ধ। সংক্ষেপে সে রাতের ঘটনা বলি।
২৫ মার্চের রাতেই ভাই, তার বন্ধুরা ও পাড়ার লোকজন জানতে পারেন পাকিস্তানি আর্মিরা বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বন্দি করতে আসছে, আর সে কাজে বাধা দেওয়ার জন্য তারা সোবহানবাগ মসজিদের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। কেউ চিন্তাও করেনি, আর্মিরা তাদের লক্ষ করে গুলি ছুড়বে! আক্রমণ থেকে বাঁচতে যে যেদিকে পেরেছে ছুটে গেছে। ঝাঁপ দিয়েছে রাস্তার পাশের ড্রেনের মধ্যে, লুকিয়ে থেকেছে সারা রাত ওই নোংরা অন্ধকারে। কেউ আশপাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সারা রাত ওইভাবে কাটিয়ে ভোরের দিকে বাড়ি ফিরেছিল তারা।
মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই তো শুরু। তখনও জানি না এ যুদ্ধ কত দিনের। কীইবা বুঝতাম ওই বয়সে; বেশি কিছু না। তবে এতটুকু বুঝতাম, বঙ্গবন্ধু এক স্বপ্নের কথা বলেছেন, স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন। সেই ডাক যেন প্রতিটি বাঙালির প্রাণে নাড়া দিয়েছিল।
কখনও কখনও পাকিস্তানি আর্মিরা সব স্বাভাবিক বলে চালাতে চাইত। কিন্তু রাতে যখন লুকিয়ে লুকিয়ে রেডিওতে ‘চরমপত্র’ শুনতাম, তখন বুঝতাম যুদ্ধ চলছে। যখন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি খুলে দিয়ে আমাদের যেতে বলত, তখন যেন যুদ্ধভাবটা থাকত না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে সেই আনন্দেই যেতাম। কিন্তু সব যেন কেমন অস্থির লাগত।
আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ, কাপড়চোপড়, শুকনা খাবার তৈরি করে রাখতাম। একদল এসে উপকরণ দিয়ে যেত, আবার আরেকদল এসে তৈরি জিনিস নিয়ে যেত। কোথায়, কীভাবে, কাদের জন্য কিছুই জানতাম না। শুধু কাজ করে যেতাম। বড় ভাইবোনদের সাহায্য করতাম। কতবার পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা।
লেখক : চিত্রশিল্পী