রূবাইয়া হাসনাইন
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
মার্চের কথা শুনলেই দাদির মুখ ভারী হয়ে যায়। ভীষণ এলোমেলো দেখায় তাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ থাকে। মনে হয় কোথায় যেন তলিয়ে যায়। বিষয়টা তখন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেই।
সেদিনও পেয়ারা গাছে একটা পাখি বসে ছিল। দাদিকে বললাম, পাখিটা আমাদের পেয়ারা খেয়ে ফেলতে পারে। পাখিটাকে তাড়িয়ে দিই?
দাদি বলে উঠল, তাড়িয়ে দেবে কেন? ওরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করে নাই। ক্ষতি না করলে তাকে কিছু করতে নেই। সবার স্বাধীনতা আছে। পাখিদের স্বাধীনতা একটু বেশি। ওদের ক্ষুধা লাগলে পেয়ারা খাবে, খাক। অনেক তো আছে! একটা দুটো খেলে তেমন আর কী হবে!
দাদির কথায় আমি থেমে যাই। বলি, পাখিরা কি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে?
দাদি বলল, না। পাখিরা খুব শান্ত। তাদের কোনো অস্ত্র নেই, মানচিত্র নেই। তাই তারা যুদ্ধ করে না। যুদ্ধ করে মানুষ। কারণ, মানুষের অস্ত্র আছে, মানচিত্র আছে।
ও আচ্ছা, এই জন্যই কি তুমি মার্চের কথা শুনলে মন খারাপ করো?
না, মন খারাপ করি কই! হয়ে যায়। তোমরা তো সেসব জান না। কী ভয়াল দানবীয় কাণ্ড ছিল! তোমরা তার কিছুই দেখ নাই। দেখলে তোমাদেরও এমন হতো। মানুষ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। তখন আমি তোমাদের মতো ছোট। আমাদের বাড়িতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। চৌকির নিচে ডেরা করে সেইখানে থাকতেন। রাত হলে বেরিয়ে যেতেন। ভোর হওয়ার আগে আবার তাঁরা চলে আসতেন। এইভাবে অনেক দিন চলে গেল। একদিন কেমন করে যেন পাকবাহিনী জেনে গেল। শুনলাম, আমাদের বাড়িতে তারা আক্রমণ করবে। পুড়িয়ে দেবে। আমরা ভয়ে পাটক্ষেতের ভেতর রাতভর বসে থাকতাম। সকাল হলে বেরিয়ে আসতাম। কত দিন যে কেটে গেছে এইভাবে!...
একদিন শুনলাম, নদীর পারে দুইটা লাশ পড়ে আছে। তখন বৃষ্টির দিন। দেখলাম, আমাদের বাড়িতে যারা ছিলেন, তাদের একজন সেখানে পড়ে আছেন। অন্যজনকে চেনা গেল না। তাদের রক্ত বৃষ্টির পানিতে চলে যাচ্ছে নদীর ভেতর। নদীর পানিও রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে।
কথাগুলো বলতে বলতেই দাদির চোখ ছল ছল করে ওঠে। তাকিয়ে দেখি, দাদির চোখ থেকে আছড়ে পড়ছে সেই রক্তনদীর ঢেউ। দাদিকে তখন থামিয়ে দিয়ে বলি, আচ্ছা! তখনও কি পাখিগুলো পেয়ারা গাছে বসে থাকত?
ষষ্ঠ শ্রেণি, পলাশ সার কারখানা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পলাশ, নরসিংদী