আবু রায়হান তানিন
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩ ১৩:৪০ পিএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১৭:১৫ পিএম
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাজাহারুল হক শাহ চৌধুরী জন্ম : ১ অক্টোবর ১৯৫৫ স্থায়ী ঠিকানা পূর্ব ফরহাদাবাদ, ডাকঘর-নাজিরহাট, উপজেলা-ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম সেক্টর : ১ সেক্টর কমান্ডার : মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম জোনাল কমান্ডার : মির্জ্জা আবু মনসুর
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা ফটিকছড়ির রোসাংগিরি শীলেরহাট বাজারে বটগাছের নিচে বসে গল্প করছিলাম। প্রায় ১৫-২০ জন মুক্তিযোদ্ধা। রোসাংগিরি নয়, যুদ্ধকালে ফটিকছড়ি ছিল অঘোষিতভাবে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। প্রতিটা বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। স্কুলমাঠে আমাদের প্রশিক্ষণ চলত। স্কুলের একটি কক্ষে ছিল গোলাবারুদ। প্রয়োজনে আমরা শীলেরহাটে এসে একত্র হতাম। সেদিনও তাই হয়েছে। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনি। তাৎক্ষণিক আমরা পাল্টা গুলি আরম্ভ করি। ধীরে ধীরে আরও মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। সৌভাগ্যক্রমে হালদা নদীর ওপারে তখন কোনো নৌকা ছিল না। তাই পাকিস্তানি বাহিনী এপারে আসতে পারেনি। সেই অবস্থাতেই তিন-চার ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। আমাদের কেউ হতাহত না হলেও পরে শুনেছি পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে হতাহত হয়েছে। ব্যর্থ হয়ে তারা ফিরে যায়। যুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম সোবহান মোল্লার বাড়িতে। ওই সময় গ্রামের সব বাড়িতে ধান তোলা শেষে খড়ের গাদা ছড়ানো-ছিটানো ছিল। সেদিনের যুদ্ধশেষে প্রত্যেকে এতটা ক্লান্ত ছিলাম যে আশপাশের বাড়িতে ঢুকে খড়ের গাদায় গা এলিয়ে দিই। আর বাড়ির লোকদের খাবার দিতে বলি। স্পষ্ট মনে আছে, মহিলারা যে হাঁড়ি-পাতিলে খাবার নিয়ে আসে আমরা তাতেই খাওয়া শুরু করি। খাওয়া শেষে তিন-চার মাইল ভেতরে চলে যাই। সেখানে হাজিসাহেবের বাড়ি নামে একটা বাড়ি ছিল। সেই হাজিসাহেবের বয়স ছিল সত্তরের মতো। তিনি ছুটে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। খুঁটিয়ে দেখছিলেন কারও গায়ে গুলি লেগেছে কি না। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা কিছু শুনেছিস?’ জিজ্ঞেস করলাম কোন বিষয়ে? তিনি বললেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি একটু আগে রেডিওতে শুনলাম। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উল্লাস আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণ আগের সেই ক্লান্তি যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। সেই বিজয়ের আত্মবিশ্বাসের মধ্যে ৮ তারিখ রাতে খবর এলো, নাজিরহাট কলেজের ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। প্রচণ্ড চাঙ্গা মনোভাব নিয়ে পরদিন সকালেই রোসাংগিরি থেকে নাজিরহাট চলে যাই। গিয়ে দেখি চতুর্দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আসছেন। সাধারণ মানুষজন ছুটে এসেছেন আমাদের দেখতে। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা স্লোগান দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। সিদ্ধান্ত হলো, নাজিরহাট কলেজে সবাই অবস্থান নেবে। যেহেতু আমার বাড়ি কাছে, তাই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ডে একটা দল নিয়ে অবস্থান নেওয়ার জন্য। যাতে আবার আক্রমণ হলে ঠেকানো যায়। সেখানেই ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখি হাটহাজারীর দিক থেকে যাত্রীবাহী বাস আসছে কয়েকটা। ভেবেছি সাধারণ যাত্রী যাচ্ছে। হঠাৎ সেই সব বাস থেকে গুলি আরম্ভ হলো। আমাদের ধারণা হয়েছিল, হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দল হবে। তারাও আনন্দে ফাঁকা গুলি করছে। খেয়াল করলাম গুলি যাচ্ছে নিচ দিক দিয়ে। এর মধ্যে বাসগুলো আমাদের কয়েক গজের মধ্যে চলে এলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা আক্রমণের মুখে পড়লাম। বাজারভর্তি মানুষ। এর মধ্যে আমরাও পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করি। আমাদের দলের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। আমার ঠিক চুল ঘেঁষে দুইটা গুলি চলে যায়। খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যেÑ স্বাধীন দেশটা দেখে যেতে পারব না! বাকি যারা ছিলাম তারা গুলি করতে করতে পেছনে চলে যাই। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, বাঁচব না। একপর্যায়ে আমরা হালদা নদীর পাড়ে চলে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। সাঁতরে নদী পার হয়ে ধানক্ষেত ধরে ক্রলিং করে পিছু হটতে থাকি। তখনও আমাদের মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে গুলি হচ্ছিল। প্রায় এক কিলোমিটার পথ এভাবে যাই আমরা। সেদিন মোট ১১ জন পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হন। আবারও ক্যাম্প দখলে নেয় পাকিস্তানিরা।
আমরা চলে যাই ফটিকছড়ি হেডকোয়ার্টারে। সেখানে ভারতীয় বাহিনীও যোগ দেয়। সংগঠিত হয়ে ১৩ তারিখ আবার আমরা এদিকে আসি। সম্ভবত ১১-১২ তারিখের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী চলে যায়। তবে ১৪ ডিসেম্বর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দখলে নিই। যাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী নাজিরহাট বাজার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। নাজিরহাট ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যায়। আমাদের নদী পার হতে হবে। কিন্তু ব্রিজ ভাঙা। স্থানীয়রা মাথায় করে নৌকা নিয়ে এসে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রিজ করেছে। একটা দুইটা নৌকা নয়, শত শত নৌকা। আসলে মুক্তিযুদ্ধটা প্রকৃত অর্থে একটা জনযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। যে যার অবস্থান থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কী এক অদ্ভুত দেশাত্মবোধে সেই সময়ে সব মানুষ এক হয়ে গেল। সবার এই ঐক্যের প্রতীক ছিলেন একজন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবাইকে এক সুতোয় বাঁধার এই কৃতিত্বটা এককভাবে তাঁর। একবার চার বছরের ছেলেকে দেখলাম দৌড়ে আসছে আর হাত ইশারা করছে পালিয়ে যেতে। মুখে শব্দ করছে না। কাছে এসে শুধু বলছে, ‘পাঞ্জাবি আইয়ে হাক্কু’’। চার বছরের ছেলের মধ্যে এই বোধ কীভাবে এলো? সেই সময়টা সবাইকে পরিণত করে দিয়েছিল। সবাইকে এক করে দিয়েছিল।
অনুলিখন : আবু রায়হান তানিন, চটগ্রাম