সৈয়দ মুনজের হোসেন বাবু
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৩ ১৩:০১ পিএম
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৩ ১৩:০২ পিএম
নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধেল গল্প বলছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খায়রুল আলম
সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই। আমি তখন ৪নং সেক্টরের অধীনে কুকিতল ক্যাম্পে। মেজর সিআর দত্তের ঘুম নেই নয়নে। দিলখুশ চা-বাগানের ৮ মুক্তিযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। হামলার পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জকে নিয়ে।
রাত তখন আনুমানিক ২টা। ক্যাম্প ইনচার্জ সবাইকে ডেকে বললেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য আজ রাতের মধ্যেই বিয়ানীবাজারের সড়ক ভাঙ্গনী পুলটি উড়িয়ে দিতে হবে, যাতে করে সিলেট সদরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
ক্যাপ্টেনের নির্দেশে আমরা প্রস্তুতি নেই। অপারেশন পরিচালনার জন্য আমরা ফনি ভাই ও বাবু ভাইয়ের নেতৃত্বে ১২ জন দুই দলে বিভক্ত হয়ে রওনা হই। আমাদের পথপ্রদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন সড়ক ভাঙ্গনী এলাকার স্থানীয় ছেলে রফিক ভাই।
আমি ছিলাম তৎকালীন বুয়েটপড়ুয়া রুহুল ইসলাম বাবু ভাইয়ের দলে। আমরা কালাউছি খালের উত্তর পার দিয়ে আর অপর দল দক্ষিণ পার দিয়ে অগ্রসর হয়ে, জল-কাঁদা মাড়িয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছলাম।
আমাদের বার্তা বাহক জামাল হোসেন ইতোমধ্যে জানালেন পাকবাহিনী চার কিলোমিটার দূরে বিয়ানীবাজার ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এখানে রাজাকার বাহিনীর কয়েকজন টহল দিচ্ছে। তা শুনেই আতিকুল ইসলাম ফনি ও মাইন স্পেশালিষ্ট মাইকেল হামাগুঁড়ি দিয়ে পুলের কাছে গিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলে, পাল্টা জবাবে স্টেনগানের একটি গুলি আমার পাশে থাকা সহযোদ্ধা আহবাব আহমদ চৌধুরীর বুকের ডান পাশে এসে বেঁধে। মুহূর্তেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি টের পেয়ে আমার শার্ট খুলে ক্ষতস্থানে বেঁধে দেই। তার বুকের তাজা রক্তে আমার শরীর ভিজে যায়। নাকে আসছিল তাজা রক্তের গন্ধ।
অন্যদিকে, অপর দলটি গুলি করে করে এগিয়ে গেলে শত্রুরা আত্মসমর্পণ করলে, চারটি মার্ক ৪ রাইফেল উদ্ধার করি আমরা। তবে একজন অস্ত্রসহ ক্যাম্পের দিকে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে যে যার মতো। ততক্ষণে মাইকেল ও নূরুল প্লাস্টিক ডিনামাইট ও প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ পুলে স্থাপন করতে শুরু করে দিয়েছে। আর বাবু ভাই রাজাকারদের একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে বিয়ানীবাজার ক্যাম্পে কতজন বন্দি আছে সেই খবর সংগ্রহ করতে থাকেন।
আহবার আমাকে জড়িয়ে কাতরাচ্ছে। পুলের নিচে একটা ছোট্ট নৌকা দেখে তাড়াহুড়ো করে গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাকে নিয়ে কিছুদূর যেতেই আমাদের লাগানো চার্জে বিস্ফোরণ ঘটে। আমার কোলে শুয়ে চোখ মেলে দেখছিল আর জর্জরিত কণ্ঠে বলে উঠলÑ ‘আমরা পেরেছি।’
আমরা নৌকায় ভেসে ভেসে যাচ্ছি আর অর্ধভাঙা পুলটির দিকে তাকিয়ে রয়েছি। দূর থেকে কয়েকটি গাড়ির লাইট দেখে বুঝে গেলাম পাক হানাদার বাহিনী ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে। অপারেশন সফল হওয়ায় টিম লিডারদের নির্দেশে আমরা পুনরায় আক্রমণ থেকে বিরত থাকি।
ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নৌকা বাড়–ধা নামক স্থানে ভেড়ে। সেখানে থেকে কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ ট্রাকে করে যুদ্ধাহত বন্ধুকে ভারতের মাছিমপুর সেনানিবাসে তুলে দিতে সক্ষম হই। আমাদের সফল অপারেশনের পর হানাদার বাহিনী আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে চড়াও হয় নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর।
আমাদের সেই বার্তাবাহক জামাল উদ্দিনকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদাররা। খবরটি দু-দিন পর কুকিতল ক্যাম্পে রফিক ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরে নয়নের জলে বুক ভাসিয়েছি। মনে পড়ছিল অপারেশনের দিন জামাল খুশি মনে জানিয়েছিলেন তা স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। কষ্ট গিলে নিয়ে পরের দিন সারপার আক্রমণের ক্রোধ নিয়ে চোখ বন্ধ করি...
এদিকে, সেনানিবাসে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে দিন দিন সহযোদ্ধা আহবার সুস্থ হয়ে ওঠে।
অবশেষে দেশ স্বাধীন হলো। জামালের ঘরে এলো ফুটফুটে এক কন্যা। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা মিলে নাম দেই স্বাধীন সুন্দরী। বাংলাদেশের সমবয়সি আজ সে মেয়েটি।
মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হলে বন্ধু জামালের মুখখানি যেন ভেসে ওঠে। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আড়ালে একটি করুণ ছবি দেখতে পাই। সে ছবি আর্তনাদে জানান দেয়, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও শহীদ বাবার স্বীকৃতি না পাওয়ার দুঃখ।
জীবনের গোধূলির বেলায় আমি শেষের অপেক্ষায়। প্রতিদিনই বিদায় জানাচ্ছি সহযোদ্ধাদের কাউকে না কাউকে। এভাবে দেশে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা মিলিয়ে যাবে একদিন। যেন মিলিয়ে না যায় এই অর্জন, তরুণরা যেন তা থেকে উজ্জীবিত হয়ে অগ্রগামী এই দেশকে স্বপ্নের শিখরে নিয়ে যায়, তাদের চোখে আমরা বেঁচে থাকব, যারা অপ্রচার, প্রতিহিংসা, চিন্তায় বন্দি না থেকে স্বাধীনতা রক্ষায় যুদ্ধে নামবে, তারাই তো এ দেশ, তারাই তো এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা।
তারাই বাংলাদেশ।
অনুলিখন : সৈয়দ মুনজের হোসেন বাবু