রাতুল মুন্সী
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৩ ১১:৫৫ এএম
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৩ ১২:০২ পিএম
কর্মশালা শেষে তীরের সদস্য
আমাদের বাড়ির আশপাশে একটা সময় যে ছোট বনজঙ্গল ছিল, সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দেখা যেত বন্যপ্রাণীর মেলা। উঠানে জড়ো হওয়া হাঁসমুরগিকে হঠাৎ তাড়া করত বাঘডাশা। শুরু হতো মা-চাচিদের চেঁচামেচি। খুপরিতে হাঁসমুরগি তোলার সময় যখন দেখা যেত একটা-দুইটা কম, তখন বকুনি একটাও মাটিতে পড়ত না। আকাশে শকুন ওড়া দেখলেই বোঝা যেত কোথাও গরু মারা গেছে। হরেকরকমের পাখির গল্পগুজবে মুখর হতো বাড়ির চারপাশ।
যখন পাখির কিচিরমিচিরে কারও কথা শোনা যেত না, অনেক সময় আমাদের মা-চাচিরা পাখিদেরও বকা দিতেন। আবার সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোনা যেত পাখিদের কাজকর্মের হিসাব। কে কোথায় যাবে, কার কাজ কী!
আমরা পাখির গল্প, কথা বুঝতে না পারলেও ওদের জীবন, খাদ্য, বাসস্থানের নিয়মপদ্ধতি থেকে একটা ধারণা নিতে পারি। ওরাও তো ঘর বাঁধে, সংসার করে। প্রতিবেশী প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করে। একসময় জীববৈচিত্র্য ও পাখির আবাসস্থল বনজঙ্গল এখন আর নেই। এখন আর নানা-দাদুর ঘুম ভাঙে না এসব পাখির কিচিরমিচিরে।
এসব জায়গায় উঠছে আমাদের থাকার ঘরবাড়ি, না হলে অফিস-আদালত। আর বেশিরভাগ দেখা যাচ্ছে অধিক মুনাফার আশায় জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বনজঙ্গল কেটে রোপণ করা হচ্ছে পাখির আশ্রয় নেওয়ার অনুপযোগী কাঠের গাছ। যে গাছে খাবার নেই, বাসা বাঁধার জায়গা নেই। আমরা এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক যে ভুলেই গেছি প্রকৃতিতে থাকা জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী বিনা লাভে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছে। তাদের টিকিয়ে রাখা দরকার।
তারা যাতে খুব সহজে খাবার পায়, বাসা বাঁধতে পারে সেই উপযোগী পরিবেশ দিলে তারা নিজেদের মতো বাসা তৈরি করে নিতে পারবে। প্রজনন করতে পারবে। আবার দেখা যাচ্ছে শীত এলেই চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে যায় পাখি শিকারের। কিন্তু আমাদের একটুকু চিন্তা মাথায় আসে নাÑ শীতে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসা পাখিরা আমাদের মেহমান।
বাড়িতে মেহমান এলে যেমন আমরা যত্ন-আত্তি করতে ব্যস্ত হয়ে যাই। অতিথি পাখিদের জন্যও আমাদের তা-ই করা উচিত। আবার স্থানীয় পাখি শিকারি তো আছেই। বাস্তুচ্যুত এসব বন্যপ্রাণী ও পাখির জন্য খুব মায়া লাগত, পীড়া দিত পরিবেশ-প্রকৃতি সচেতন দুজন মানুষ সোহানুর রহমান সোহাগ ও নাজমুল হকের। তারা তখন ছাত্র। ছোট মানুষ তারা, তাদের কথা কে শোনে।
দু’জন মিলে ছুটে যান তৎকালীন পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহীর বিভাগীয় প্রধান নাজমুল হকের অফিসে। তিনি তখন ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ের শিক্ষক আবু হায়দারের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেন।
পরে আবু হায়দার, জিয়াউর রহমান একত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিসে মিটিং করেন। জিয়াউর রহমানের অফিসে ৩ জুন আরেক দফা মিটিং করে ২০১১ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড ইনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, সংক্ষেপে তীর। বর্তমানে সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় বগুড়ার ঐতিহ্যবাহি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আজিজুল হক কলেজ। ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে বছরব্যাপি উত্তরাঞ্চলের জীববৈচিত্র ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এ সংগঠনের মূল স্লোগান- শেখো, করো, শেখাও, পরিবেশ বাঁচাও। শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদী এ সংগঠন ২০১১ সাল থেকে দিনরাত নিরসল কাজ করে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী রক্ষায়।
বন্যপ্রাণী রক্ষা, সংরক্ষণ, মুমূর্ষু বন্যপ্রাণী, পাখিকে সেবা দেওয়া থেকে শুরু করে সুস্থ হয়ে গেলে উপযুক্ত জায়গায় ছেড়ে দিচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, বন্যপ্রাণী ও পাখিদের জন্য রোপণ করছেন পরিবেশ উপযোগী গাছ। বর্তমানে তীরের প্রধান কার্যালয় বাদে রয়েছে চারটি শাখা।
১. তীর গাইবান্ধা সরকারি কলেজ শাখা
২. তীর বিহারহাট
৩. তীর রামনগর পাখি কলোনি
৪. তীর বিলচাপড়ী পাখি কলোনি
অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কাজ করা এ সংগঠন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছে রাষ্ট্রীয় বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ২০২১। পেয়েছে শ্রেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবী পুরস্কার ২০১৬ (বিবিসিএফ)।
সংগঠনটি বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক হওয়া ৩৫ থেকে ৪০টির ওপর শকুন উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিয়েছে। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ২০০ বছরের প্রাচীন বটগাছ কেটে ফেলার বিরোধীতা করে রক্ষা করেছে গাছটি। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় তিনটি গাছে স্থায়ী নিবাস তৈরি করে দিয়েছে শামুকখোল পাখির। এছাড়াও সরকারি আজিজুল হক কলেজ প্রাঙ্গণটিকে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদে পাখিদের বসবাসের উপযোগী করে।
সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে তীরে রয়েছেন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ স্বেচ্ছাসেবী। প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছেন কলেজে পড়তে আসা নতুন নতুন শিক্ষার্থী। সরকারি আজিজুল হক কলেজের বিভিন্ন বিভাগের ১৫-২০ জন শিক্ষক যুক্ত আছেন উপদেষ্টা হিসেবে। অলাভজনক এ সংগঠন সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রম ও অর্থ দিয়েই পরিচালিত হয়ে আসছে।
দুবারের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান সংগঠন নিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কলেজে পড়া অবস্থাতেই পরিবেশ সম্পর্কে জানছে, শিখছে। পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি একটা ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশা করি।’