× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রোমাঞ্চকর অভিযান

অরণ্যের দিনরাত্রি...

নিগার তানজিয়া

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১২:৩০ পিএম

আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১২:৪৫ পিএম

পাহাড়ের বুনো সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলতে থাকে একদল অভিযাত্রী                                        ছবি : লেখক

পাহাড়ের বুনো সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলতে থাকে একদল অভিযাত্রী ছবি : লেখক

ছবি : লেখক

ছবি : লেখক

পাহাড়ের বুনো সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে একদল অভিযাত্রী যাত্রা করে মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্টে। একে একে জনাচন্দ্র, রালাই, বোলায়, খিদু মেম্বার, মেনতংপাড়া পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। আট দিনের রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প তুলে ধরেছেন নিগার তানজিয়া

পাহাড় না সমুদ্র?- এই প্রশ্নে আমি সব সময় পাহাড়ের দিকেই থাকি। পাহাড় মানেই যেন উদ্দেশ্যহীন সবুজে যাত্রা, পাহাড় কোনো সময়ই আমাকে হতাশ করে না। একেক ঋতুতে সে একেক রূপ নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়। পাহাড়ের এই বুনো সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই হয়েছিল আমার আন্ধারমানিক এবং মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্ট ট্যুর। এ যেন টোয়াইন কালের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মাতামুহুরীর আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো। মোট ৮ দিনের ট্যুর ছিল আমাদের। 

যাত্রা শুরু হয়েছিল আলিকদমের আমতলী ঘাট হয়ে বোট জার্নির মাধ্যমে দুসুরী বাজার থেকে। আন্ধারমানিক হয়ে মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্টে যাব আমরা। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য যেহেতু রিজার্ভই, আমি এখানে আন্ধারমানিক পর্যন্ত যাত্রাটা স্কিপ করব। থাংকোয়াইন ঝরনা পাড়ি দিয়ে হাজিরামপাড়া ক্রস করে পালংখিয়ংয়ের পাশ ঘেঁষে একে একে জনাচন্দ্রপাড়া, রালাইপাড়া, বোলায়পাড়া, খিদু মেম্বারপাড়া পাড়ি দিয়ে প্রায় ২৩শ ফিট ওপরের মেনতংপাড়া হয়ে সেই নারিশ্যা ঝিরি ঘুরে আসতে দুই রাত তিন দিন ইতোমধ্যে শেষ আমাদের। আন্ধারমানিকের দলকে বিদায় দিয়ে আমরা ৭ জনের রির্জাভ টিম রয়ে যাই মেনতংপাড়ায়। আজকের রাতটা আমরা এখানেই কাটাব। 

মেনতংপাড়া, প্রায় ২৩শ ফিট ওপরের এই পাড়াটি ৬-৭টি ঘর নিয়ে গঠিত। তীব্র পানি সংকটের কারণে অচিরেই এই পাড়া থেকে তারা অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার চিন্তা করছে। হারিয়ে যাবে চিরতরে আমাদের দেখা অন্যতম সুন্দর একটি পাড়া। যেদিকেই তাকাই- দিগন্তজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজের হরেক শেডের পাহাড়গুলো জানান দিচ্ছিল কত ক্ষুদ্র আমরা! এখনও মনে আছে- সেদিন সন্ধ্যায় এত উঁচু থেকে আশপাশের এই পাহাড়গুলো অবলোকন করতে করতে একই সঙ্গে ভালো লাগা এবং কষ্টের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। ভয়ংকর সুন্দরের প্রভাব মনে হয় একেই বলে। রাতে এই পাড়ার অজস্র তারার সাক্ষী হয়ে থাকার কথা এই চোখ কীভাবে ভুলবে? শহরের দূষণে যে জিনিস কল্পনাতীত- পাহাড়ের মুক্ত, পবিত্র নির্ভেজাল আকাশ- তার অনন্য রূপ নিয়েই সে রাতে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল।

রাতে টিম মেম্বাররা যখন রান্নার কাজে ব্যস্ত, আমরা কয়েকজন চুলোর পাশে বসে পড়লাম পায়ে আগুনের ছেঁকা দিতে, পাহাড়ের একমাত্র মেডিসিন। বিকালে পিচ্ছিল একটা পাথরে ওপর আমরা তিন জন একই সঙ্গে পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ডান পায়ের হাঁটুতে ভালোই একটা টান খেয়েছি। একটা জিনিস এখানে উল্লেখ করার মতো মনে হলো- এই পাড়ার ঘরগুলোয় পুরো রাত কোন এক বিচিত্র সুরে তাদের নিজিস্ব ভাষায় ধর্মীয় গান চলতে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এই ধর্মীয় গান তাদের যেকোনো প্রকার অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করবে। এই বিচিত্র সুর শুনতে শুনতেই যার যার স্লিপিং ব্যাগে কখন যে ঘুমিয়ে পরি মনেই নেই।

পড়ুন কুড়িগ্রামের ঐতিহ্য ভ্রমণ

পরদিন সকালে সূর্যোদয় দেখেই আমরা রওনা দেই মরিফাতং চূড়া দেখতে। পাড়ার পানি সংকটের কারণে কেউ মুখ ধুতেও তাদের পানি নষ্ট করিনি। মনে হচ্ছিল- খাওয়ার পানি যে ব্যবহার করলাম এই জন্যই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, মুখ ধোয়া তো তখন বিলাসিতা! যা হোক, প্রায় ২৭৪০ ফিট উঁচু চিম্বুক রেঞ্জের অন্যতম চূড়া মরিফাতংয়ে উঠতে গিয়ে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছিল। একে তো রাস্তা ভুলে যাই, তার ওপর ছিল বাঁশঝাড়। যাত্রা পথটা ছিল কয়েকশ বছরের পুরোনো বিশাল বিশাল গাছে পরিপূর্ণ এক অরণ্য মাড়িয়ে। মানুষের ভয়াল থাবা অতদূর যেতে পারে না বলেই হয়তো এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনও অক্ষত আছে। পাড়ায় আসার পর নাজমুলের রান্না করা নুডলস মুখে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পরি পরবর্তী গন্তব্যে। আমরা যে পথে যাত্রা করেছি এসব সাধারণত কেউ ব্যবহার করে না, তাই মোটামুটি অযোগ্য হয়ে যায় হাঁটার। কিন্তু কিছুই করার নাই। এই পথেই যেতে হবে। তাই কোথাও গাছের শিকড় ধরে, সামনের জনের পা ধরে আবার কোথাও-বা জংগল কেটে হাঁটছি। পথ আর শেষ হয় না। এদিকে বিকাল শেষ হয়ে আলোও নিভে যাচ্ছে। সবার চিন্তা আলো থাকতে থাকতেই পাহাড় থেকে নামা লাগবে। এদিকে আমার সেই পায়ের ব্যথা তো আছেই। এইবার যুক্ত হলো রিফাত ভাইও। সাকীর ব্যথা তো আরও আগে থেকেই। শিংঘ্রাওপাড়ায় যখন পৌঁছালাম তখন রাত। আহা কী পথটাই না সবাই পাড়ি দিয়ে আসলাম! সে রাতটা আমরা শিংঘ্রাওপাড়াতেই ছিলাম।

পরদিন আমাদের গন্তব্য পাণ্ডবপাড়া। আগের দিন মারাত্মক চাপ নেওয়ায় আজকের পরিকল্পনা ছিল ধীরে পথচলার। হেলেদুলে পাণ্ডবপাড়ায় পৌঁছানোর পর খেয়াল করলাম আজ তাদের পাড়ায় হয়তো কোনো এক বিশেষ দিন। পাড়ার মেয়েরা জুম থেকে ফিরে ঝিরি থেকে গোসল শেষে সেজেগুজে ঘুরঘুর করছে সন্ধ্যা থেকেই। দেখলাম সবাই একসঙ্গে হয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় গাওয়া গানের সঙ্গে নাচতে শুরু করছে। তাদের অনুমতি নিয়ে আমি মোবাইল বের করলাম ভিডিও আর ছবি তুলতে। আর আমাদের আবিদ, নাজমুল, মামুন তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দিল। 

পরদিন ভোরে উঠে রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। কখনও ঝিরি, কখনও পাহাড়- কখনও কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে আমাদের দল এগিয়ে যায়। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম রুইতন ডাকাতপাড়ায়। এই পাড়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করি নতুন কোনো পাড়ায়। 

আবার সেই হাঁটছি তো হাঁটছিই। এইবার আমরা পথ ভুল করি। যদিও তা উল্টো শাপে বর হয়ে যায়। এত সুন্দর একটা জুমঘরের দেখা পেয়েছি আহা! আশপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ! মাঝখানে ছোট্ট একটা জুমঘর। ইতোমধ্যে জোঁকের কামড়ে সবার পা রক্তাক্ত। জুমঘরটায় কিছুক্ষণ সময় দিলাম আমরা। চালের ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চিত এই জুমঘরটায় আজকের রাতটা কাটিয়ে দিতাম। সবাই আফসোসও করছিলাম এই জন্য। যাই হোক, একটু পর পাহাড়ি এক ছেলে এলে তার কাছে শুনলাম এটা আন্দালিপাড়ার জুম। তার দেখানো পথে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। ৬/৭ ঘর নিয়ে গঠিত আন্দালিপাড়ায় যখন পৌঁছলাম তখন বিকাল ৫টা। আজকের রাতটা কাটাব এখানেই।

পরদিন আন্দালি ঝিরি পাড়ি দিয়ে মেনপংপাড়ায় যখন পৌঁছলাম, তখন ২.৩০ ঘণ্টা ট্রেকিং শেষ আমাদের। কিছুক্ষণ জিরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বিশাল এক পাহাড় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঠিক করি দুসুরী ঝিরি হয়ে এগিয়ে যাব। কিন্তু এতে যে প্রায় বুকসমান পানি পার করা লাগবে কে জানত তখন। কিছু জায়গা এমন ছিল- রাস্তাই পাওয়া যাচ্ছিল না। নামলেই ডুবে যাব। তখন পাশের পাহাড়ে বাইপাস বানিয়ে আবার নিচে নামা। ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে আমরা মাতামুহুরীর উৎসমুখে পৌঁছলাম। কথিত আছে, একপাশে মাতা দুসুরী ঝিরি, আর অন্যপাশে ফাতরা খাল মিলে এই জায়গাতেই উৎপত্তি হয়েছে মাতামুহুরী নদীর। এখানে অল্পক্ষণ সময় কাটিয়ে ঠিক সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছাই পাহাড়ভাঙ্গা পাড়ায়।  

পরদিন আমাদের গন্তব্য মাছখুম পাড়া। এই পাড়ার আসল সৌন্দর্য পাড়ার নিচে থাকা এই মাছখুমই। স্বচ্ছ সবুজাভ পানিতে সবাই ভেলা ভাসালাম। সুড়ঙ্গের মতো জায়গায় গঠিত এই খুম। এরপর আমরা যাই আলিকদম। প্রায় ৪ ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে আমরা পুয়ামুহরী বাজারে পৌঁছলাম। অবশেষে আমরা আলিকদম যখন পৌঁছাই তখন বিকাল। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের ৮ দিনের ‘অরণ্যের দিন-রাত্রি’ শেষ হলো। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা