× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ব্যবসায় নারীর উত্থানপর্বের কথা

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৮ পিএম

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩ ১৪:২৩ পিএম

ব্যবসায় নারীর উত্থানপর্বের কথা

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখতে পাই, পুরুষশাষিত সমাজব্যবস্থায় নারীর পরিমণ্ডল ঘরগৃহস্থালির কাজ সামলানো, সন্তান লালন-পালনসহ সবকিছু যেন সংসারকে ঘিরেই। সেই নারী যখন সমাজের বাধা উপেক্ষা করে ব্যবসার মতো জটিল বিষয় শুরু করার দুঃসাহস দেখায় এবং সেটাতে সফলও হয়, তখন তা অনন্য উদাহরণ হয়েই থাকে। এমন অনেকে আছেন, যারা  নিজ চিন্তা ও কর্মদক্ষতায় ব্যবসায় নাম লিখিয়ে সাফল্য লাভ করেছিলেন। 

একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হতো, নারীর কাজ মানেই পুরুষ ও সংসারের সেবা করা। কিন্তু ইউরোপজুড়ে সপ্তদশ শতকের নবজাগরণের কালে নারীরাও যে পুরুষের মতো ঘরের বাইরের কাজে অংশ নিতে পারেন এবং সেটা উচিতও- এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়। ১৭৯২ সালে ব্রিটিশ নারী অদিকারকর্মী মেরি ওলস্টোনক্রাফটের ‘এ ভিন্ডেকেশন অব দ্য রাইটস অব ওমেন’ শিরোনামের একটি প্রকাশনা বাজারে আনেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল, নারীর অধিকারের বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি। এখানে তিনি আরও বলতে চেয়েছেন, শিক্ষিত নারীরাও দেশের সমাজের ও দেশের সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন। তারও আগে থেকে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি নারীরা ব্যবসায় নাম লেখান। আলোচিত কয়েকজন নারী ব্যবসায়ীর কথা জেনে নেওয়া যাক।

মার্গারেট হার্ডেনব্রোক

প্রথম দিককার একজন নারী ব্যবসায়ী মার্গারেট হার্ডেনব্রোক। ২২ বছর বয়সী ডাচ এই নারী নিজ দেশ থেকে ১৬৫৯ সালে তৎকালীন নিউ আমস্টারডাম তথা বর্তমান আমেরিকার নিউ ইয়র্কে চলে আসেন। এখানে তিনি এক কাজিনের ব্যবসায় ডেবট কালেক্টরের কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পিটার ডি ভ্রিস নামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি ডাচ ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে রান্নার তেল ও পশম বিক্রির ব্যবসায় নাম লেখান। ১৬৬১ সালে স্বামী পিটারের মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তি ও ব্যবসার মালিক হয়ে যান মার্গারেট। তখন তিনি তার পশমের ব্যবসা আমেরিকা ছাড়িয়ে নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন কলোনিতে ছড়িয়ে দেন। কয়েক বছরের মধ্যে নিজস্ব জাহাজেরও মালিক হন মার্গারেট। এরপর সব সম্পদ নিজের আয়ত্তে রেখে স্বামীর অধীনে না চলার বিশেষ আইনে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ১৬৯১ সালে মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন নিউ ইয়র্কের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী নারী।

রেবেকা লুকেন্স

এবার বলি রেবেকা লুকেন্সের কথা। ১৮২৫ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বাবা ও স্বামীর মৃত্যুর পর ব্রান্ডিওয়াইন আয়রন ওয়ার্কস অ্যান্ড নেইল ফ্যাক্টরি নামের পারিবারিক ব্যবসার মালিক বনে যান তিনি। পরিবার ও সমাজের বিরোধিতার পরও তিনি এ দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। উপরন্তু এই ব্যবসাকেই নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। স্বামীর মৃত্যুর আগে এই কোম্পানি রেলের স্টিম ইঞ্জিনের জন্য বিশেষ লোহার পাত তৈরি করত। রেবেকাও এই কাজ ধরে রাখেন। পাশাপাশি ১৮৩০ সালের দিকে ফিলাডেলফিয়া-কলম্বিয়া রেল রোডের কাজ শুরু হলে সেখানে কমিশনের ভিত্তিতে সরঞ্জাম ও লোকোমোটিভের জন্য লোহা উৎপাদন শুরু করেন। নতুন এই চিন্তায় বেশ সাফল্য আসে। ১৮৩৭ সালে গ্রেট প্যানিক তথা অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সময়ও তিনি কারখানা বন্ধ রাখেননি। এ সময় তিনি কর্মীদের বেতন দিতে না পারলেও নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতেন। রেবেকা লুকেন্সকে বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগের প্রথম নারী সিইও। 

এলিজাবেথ হবস কেকলি

এলিজাবেথ হবস কেকলির জন্ম ১৮১৮ সালে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায়। দাস বাবা-মায়ের সন্তান এলিজাবেথ ছিলেন ঊনবিংশ শতকে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে নামকরা পোশাক প্রস্তুতকারক। মায়ের কাছ থেকে সেলাই শিখে সেই কৈশরেই নারীদের পোশাক বানিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। অর্থের বিনিময়ে নিজের ও তার ছেলের স্বাধীনতা কিনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। মুক্ত জীবন লাভ করে ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে আসেন এলিজাবেথ। এখানে সেলাইয়ের কাজ শুরুর পর আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী ফার্স্ট লেডি মেরি টড লিংকন তাকে হোয়াইট হাউসে নিজের পার্সোনাল ডিজাইনার করে নিয়ে আসেন। চার বছর পর আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুর এ কাজে ইস্তফা দেন। এ সময় তিনি আমেরিকার গৃহযুদ্ধে আহত কালো সৈনিকদের জন্য গঠন করেন কনট্রাব্যান্ড রিলিফ অ্যাসোসিয়েশন। হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে লেখেন আত্মজীবনী, নামÑ ‘বিহান্ড দ্য সিন অর থার্টি ইয়ারস অব স্লেভ অ্যান্ড ফোর ইয়ারস ইন দ্য হোয়াইট হাউস’। পরবর্তী সময়ে কিছু বিতর্কের সম্মুখিন হলেও কেকলি উইলবারফোর্স ইউনিভার্সিটি অব ওহাইওতে সেলাই ও গৃহস্থালি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

ম্যাডাম সি জে ওয়াকার

এবার বলব এমন একজনের কথা, যিনি নিজ চেষ্টায় আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম নারী মিলিয়নিয়ার। কৃষ্ণাঙ্গকে এই মানুষটিকে অনেকে ‘প্রথম’ নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও চিহ্নিত করেন। তার নাম ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। জন্ম ১৮৬৭ সালে। পারিবারিক নাম সারাহ ব্রিডলাভ। দাস বাবা-মায়ের সন্তান সারাহ জন্মের পরপরই দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বিয়ে করেন ১৪ বছর বয়সে। লিলিয়া নামের এক মেয়ের জন্মের পর স্বামীও মারা যান। সারাহ তখন সেইন্ট লুইসে চলে আসেন। এবং মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে থাকেন। ১৯০৪ সালে সারাহ অ্যানি টার্নবো ম্যালোনি নামের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর হেয়ার কেয়ার কোম্পানিতে যোগদান করেন। এই কাজে এসেই তিনি মূলত নিজে থেকে কিছু করার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। একদিন স্বপ্নে দেখতে পান, এক লোক তাকে চুল দ্রুত বড় হওয়ার একটি কার্যকর নির্যাস তৈরির পন্থা বাতলে দিচ্ছেন। তিনি সেই মোতাবেক তৈরিও করেন হেয়ার গ্রোয়িং টনিক। এবং সেটা ঘরে ঘরে গিয়ে বিক্রি শুরু করেন। এই সময়ে তিনি চার্লস জোসেপ ওয়াকার নামের একজনকে বিয়ে করে নিজের নাম পাল্টে রাখেন ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। এবং ‘ম্যাডাম ওয়াকার’স ওয়ান্ডারফুল হেয়ার গ্রোয়ার’ নামে একটি কোম্পানিও খোলেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই কোম্পানিটি সমাজের সাদা-কালো সবার মাঝেই জনপ্রিয়তা পায়। এবং প্রতিবছর পাঁচ লাখ ডলার মূল্যের তেল বিক্রি করতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যেই ওয়াকারের মিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়ে যান। যদিও সমাজের কালো মানুষের জন্য ওয়াকার ছিলেন ‍উদারহস্ত। আয়ের একটা বিরাট অংশ তিনি ব্যয় করতেন তার সমগোত্রীয় মানুষের সেবায়। প্রায় চল্লিশ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নারী-পুরুষকে তিনি স্বাবলম্বী করেছেন নিজের টাকায়। এ ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্যও দান করতেন তিনি নিয়মিত।

ম্যারি টিউক

চা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রথম সারির নারী ব্যবসায়ী ইংল্যান্ডের ম্যারি টিউক। ১৬৯৫ সালে ইয়র্কশায়ারে জন্ম নেওয়া তুকেস মাত্র ২৮ বছর বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বড় সন্তান হিসেবে ভাই-বোনসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। আঠারো শতকে যখন নারী স্বাধীনতার বালাই ছিল না, এমনকি নারীদের নিজ নামে কোনো সম্পত্তি রাখারও অধিকার ছিল না, সেই সময় ১৭২৫ সালে আয়ের পথ হিসেবে ম্যারি ইয়র্কশায়ারের ওয়ালমেট এলাকায় একটি মুদি দোকান দেন। দোকানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি চা বিক্রি শুরু করেন। তার দোকানটি জনপ্রিয়তাও পায়। কিন্তু বাদ সাধে সেখানকার আইন। ইয়র্কশায়ারের ‘সোসাইটি অব মার্চেন্ট অ্যাডভেঞ্চার’-এর সদস্য ব্যতীত ব্যবসা করার অনুমতি ছিল না কারো তখন। নানামুখী হুমকির পাশাপাশি জেল-জরিমানার শাস্তি বরণ করতে হয় তাকে। এসবের মধ্য দিয়েও আট বছর তিনি দোকান চালিয়ে যান। অবশেষে জরিমানা প্রদান করে ব্যবসার অনুমতি পান। ইতোমধ্যে ম্যারির চা ব্যবসা বেশ প্রসার লাভ করে। চায়ের সঙ্গে চকলেট বানিয়েও বিক্রি করতে থাকেন। তার প্রতিষ্ঠানের চা ও চকলেটের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

ম্যারি লিটল টিউইনিং

চা ব্যবসায় নাম লিখিয়ে সাফল্য পেয়েছেন ইংল্যান্ডের আরেক নারী, ম্যারি লিটল টিউইনিং। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের প্রাচীনতম এবং বর্তমান সময়ের অন্যতম চা আমদানি-রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিউইনিংসের প্রতিষ্ঠাতা থমাস টিউইনিংয়ের ছেলে ড্যানিয়েল টিউইনিংয়ের স্ত্রী। ১৭০৬ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি বাপ-বেটা থমাস ও ড্যানিয়েল টিউইনিংয়ের কল্যাণে বেশ বড় আকারই ধারণ করে। ১৭৬২ সালে ড্যানিয়েলের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন ম্যারি টিউইনিং। পুরো ইউরোপেই চা ব্যবসা যখন তুঙ্গে, ওই সময়ে ম্যারি টিউইনিং ১৭৮৩ পর্যন্ত টানা ২১ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিউইনিংসের ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালন করে যান।

আওরা কেই

আঠারো শতকে যখন ইউরোপ তথা ব্রিটেনে ম্যারি টিউক আর ম্যারি টিউইনিং চা ব্যবসায় সফল, তখন ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এশিয়া তথা জাপানের নারী ব্যবসায়ী আওরা কেই বিরাট বিপ্লবই ঘটিয়ে ফেলেন। জাপান থেকে চা প্রথম ইউরোপে রপ্তানি হয়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে চা-বাণিজ্যে জাপান আগ্রহ দেখায়নি প্রথমদিকে। চা উৎপাদন ও রপ্তানিকে বাণিজ্যিক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন আওরা কেই। জাপানের নাগাসাকির এক ধনাঢ্য তেল ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে আওরা। নিজে নিজে কিছু করতে চান বলেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৮৫৩ সালে তিনি জাপানে ব্যবসার কাজে আসা এক ওলন্দাজ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে স্থানীয় বিশেষায়িত ‘উরেসিনো-চা’ তথা ‘গ্রিন টি’র কিছু নমুনা ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পাঠান। এর তিন বছর পর এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী কয়েক টন গ্রিন টির অর্ডার দেন। এভাবে অল্প দিনের মধ্যেই তার কাছে মোট ৭২ টন চায়ের অর্ডার আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। নাগাসাকির কেইউশু প্রদেশের সব চাষি মিলে যেখানে একবারে ৬ টনের বেশি চা উৎপাদন করতে পারে না, সেখানে এত বড় অর্ডার সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায় পড়ে যান আওরা কেই। হঠাৎ করেই গ্রিন টির কদর বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ চাষিরা উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি চা ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে সেখানে। চায়ের উৎপাদন ও বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই মুক্ত বাণিজ্যে নাম লেখায় জাপান।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা