মনের স্কুল
তানভীর তানিম
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৯ পিএম
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা মনের স্কুল প্ল্যাটফর্ম ছবি : মনের স্কুল
নিত্য হাজারো কাজের ভিড়ে হাঁপিয়ে ওঠা আমরা কজনই বা নিজের মনের যত্ন নিই! অথচ নিজের মনের যথোপযুক্ত পরিচর্যা করলে আত্মঘাতী চিন্তা করার পরিস্থিতি আসে না। এমন ভাবনা থেকেই যাত্রা করে ফাইরুজের ‘মনের স্কুল’। ফাইরুজের সঙ্গে তার মনের স্কুল বিষয়ে কথা বলেছেন তানভীর তানিম
ভাষা শিক্ষার জন্য রয়েছে ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার জন্য আছে আইটি স্কুল। কেমন হতো, যদি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও একটি স্কুল থাকত! এ চিন্তাকেই বাস্তব রূপ দিয়েছেন এক নারী। তার নাম ফাইরুজ ফাইজা বিথা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এ ছাত্রী চালু করেছেন এমন স্কুল, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষা এবং সেবা দুটোই একসঙ্গে দেওয়া হয়। ফাইরুজ যার নাম দিয়েছেন মনের স্কুল।
যেভাবে শুরু হলো
ফাইরুজ লেখাপড়া করেছেন নিজ শহর খুলনায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিষয়ে। একদিন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক আয়োজিত ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’-এর একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এই কর্মশালায় একটি সমস্যার লক্ষণ থেকে প্রধান সমস্যা নির্ধারণ করতে হয়। সেশন শেষে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে স্থানীয় একটি সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে বলা হয়। এই ছোট দলগুলোর মধ্যে একটি দলে ছিলেন ফাইরুজ ফাইজা বিথা, রাগিব শাহরিয়ার, আরিফ ইসলাম, মুহিব উল্লাহ ও মাহবুবুর রহমান। সেদিন সেই দলের সবাই একমত হন খুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে। এভাবেই শুরু হয় মনের স্কুলের ভিত গড়ার কাজ। এ সম্পর্কে ফাইরুজ ফাইজা বিথা জানান, আমরা আসলে চেয়েছিলাম মানুষ তাদের কথা শেয়ার করতে পারবেন, এ রকম একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার। এরপর আমরা তাদের জন্য ওয়ার্কশপ, কাউন্সোলিং এগুলোও দেওয়া শুরু করি।
আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম
ফাইরুজের ইচ্ছা ছিল শুরুতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) কয়েকটি বিভাগের সামনে একটি করে বাক্স বসাবেন। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব কথা, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যার কথা চিরকুটে লিখে সেখানে ফেলবেন। মনের স্কুল দলের সদস্যরা চিরকুট সংগ্রহ করবেন এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কাউন্সেলিং সুবিধা দেবেন। কিন্তু ফাইরুজরা যা আবিষ্কার করলেন, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তারা। তাদের রেখে আসা অধিকাংশ বাক্সই খালি পড়ে থাকছে। অথচ অনেকেই মানসিক চাপে থাকার কথা অবলীলায় বলেন, এ ধরনের কথা বলার জন্য মানুষ খোঁজেন, ফাইরুজও শোনেন ঘনিষ্ঠ মানুষদের একান্ত কথা। তখন তিনি বুঝলেন, শিক্ষার্থীরা মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যার কথা কাছের মানুষ ছাড়া কারও কাছে বলতে চান না। এবার মনের স্কুলের সদস্যরা অন্যভাবে চেষ্টা করলেন। তারা চিকিৎসাক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত প্যারামেডিক ধারণাটিকে কাজে লাগালেন। এই ধারণা অনেকটা এমন-একজন ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেন তার আশপাশে কেউ অসুস্থ হলে তিনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারেন এবং রোগীর অবস্থার অবনতি হলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। মনের স্কুল সেটাই বেছে নিল।
করোনাকালে মনের স্কুল
করোনা মহামারি যেন আশীর্বাদ হয়েই এলো ফাইরুজদের জন্য। এ সময় মনের স্কুলের কার্যক্রম পেল এক নতুন মাত্রা। করোনা এলো, মহামারি শুরু হলো- মানুষ হয়ে পড়ল ঘরবন্দি। তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মানসিক স্বাস্থ্য। ঘরে থাকার সে সময়ে মনের স্কুলও কৌশল বদলাল। অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করল তারা। সেই থেকে এখনও প্রতিদিন ১০ জন প্যারাকাউন্সেলর বর্তমানে মনের স্কুলের প্রশিক্ষণ নিয়ে সক্রিয় আছেন, যারা সম্পূর্ণ বিনা খরচে মানুষকে প্রাথমিক কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
গোলকিপার্স গ্লোবাল গোল অ্যাওয়ার্ড
২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ১৯৩ জন রাষ্ট্রনেতা বসেছিলেন এক বৈঠকে। সেখানে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের জন্য ১৭টি লক্ষ্যের অঙ্গীকার করা হয়। এসব লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বের নানা প্রান্তে যারা কাজ করছেন, তাদের খুঁজে বের করে গোলকিপার্স গ্লোবাল গোল অ্যাওয়ার্ড দেয় বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। ২০২১ সালে এই অ্যাওয়ার্ড বিশ্বের যে চারজনকে দেওয়া হয়, তাদের একজন বাংলাদেশের খুলনার মেয়ে ফাইরুজ ফাইজা বিথার। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা মনের স্কুল অনলাইন প্ল্যাটফর্মের জন্য তিনি এ পুরস্কার পান। এই স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফাইরুজ চার বছর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন। গোলকিপার্স গ্লোবাল গোল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে ফাইরুজ ফাইজা বিথা বলেন, প্রথম এটা করা হয়েছিল মানুষের নানা বিষয়গুলো শোনার জন্য। তারা এখানে আসবে তার কথাগুলো শেয়ার করবেন এবং তার পরিচয় গোপন রাখা হবে। তিনি আরও জানান, প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরে ১৬ হাজার মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে মনের স্কুল। শুনেছে মানুষের মনের কথা, দিয়েছে সমাধান।
জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড
দেশ গঠনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার স্বীকৃতি হিসেবে তরুণদের ১৫ সংগঠনকে দেওয়া হয় ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’। সাম্প্রদায়িক বৈষম্য হ্রাস ও অধিকার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা, দক্ষতার উন্নয়ন, সর্বব্যাপী শিক্ষা, বিশেষভাবে সক্ষমদের (প্রতিবন্ধী) জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, উদ্ভাবক, খেলাধুলা এবং ফিটনেস, জনসচেতনতা সৃষ্টি, লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসসহ আরও বেশ কিছু বিভাগে এ সম্মাননাগুলো প্রদান করা হয়। সর্বমোট ৭শটিরও বেশি সংগঠন এতে অংশগ্রহণ করে। এরপর ১২ সদস্যের তারকাখচিত জুরি বোর্ড সেখান থেকে অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত করে ৩১ সংগঠনকে। এর মধ্যে মনের স্কুল অন্যতম। এই সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের গতানুগতিক ধারার কারণে মানসিক চাপে থাকা প্রায় ১১ হাজার তরুণ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা লাভ করেছে। দেশের ৩৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই সংগঠনের প্রতিনিধি রয়েছে, যেখানে সফলতার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে মনের স্কুল। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২১ পায় সংগঠনটি।
দেশের বাইরে যাত্রা
এবার মনের স্কুল শুধু বাংলাদেশেই আবদ্ধ থাকেনি, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা পৌঁছে গিয়েছে সুদূর নাইজেরিয়াতে। বেউলাহ ইয়াংস্টার অ্যাডভান্সমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ও মনের স্কুলের মাঝে একটি mou স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে নাইজেরিয়ার শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রসারে এক নতুন যাত্রা শুরু করে মনের স্কুল। সেখানে ট্রেনিং এবং বিশেষভাবে তৈরি মডিউলের মাধ্যমে নাইজেরিয়ার নতুন প্রজন্মের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করবে মনের স্কুল।
কাজের অনুভূতি
ফাইরুজ যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন এ ধরনের কোনো সংগঠন বাংলাদেশে ছিল না। সে সময় তাদের লক্ষ্য ছিল, যে সেবাটা একজন মানুষের প্রাপ্য, তার পাওয়া উচিত- সেটা যেন তাকে দেওয়া যায়। মানুষজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং জানাচ্ছে তাদের সুফল পাওয়ার কথা। আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করি যে, এ ধরনের সেবা আমরা পৌঁছে দিতে পারছি, বললেন ফাইরুজ।