কালো মানুষের আলো
আব্দুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:১৬ পিএম
কবি ফিলিস হুইটলি। সৃষ্টিশীল এই নারী দাসত্বের শিকল ভেঙে আজ থেকে দুই শতকেরও বেশি সময় আগে বই প্রকাশ করেছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের মধ্যে যা প্রথম। সাদা চামড়ার মানুষদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি কবিতার মাধ্যমে দিয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের ডাক...
‘শ্রেণিবৈষম্য’ মানবপ্রবৃত্তির অংশ কি না তা সমাজবিদরা ভালো বলতে পারেন। যুগে যুগে শ্রেণিসংগ্রামের হাজারো ঘটনা আমাদের আন্দোলিত করেছে, হয়েছে ইতিহাসের অংশ। মানুষের গায়ের রঙও শ্রেণিবৈষম্যের ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করে। ‘কালো মানুষ’ বা ‘ব্ল্যাক পিপল’, সাদা চামড়ার মানুষের কাছে অনাদরের শব্দ হিসেবেই বিবেচ্য হয়ে এসেছে। হাজারো বঞ্চনার শিকার কালো মানুষগুলো যুগে যুগে তাদের প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে।
আজ বলব এমনই একজনের কথা, যিনি সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ পরিবেশে নিজ যোগ্যতায় সৃজনশীলতার মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। তার নাম ফিলিস হুইটলি। কালো চামড়ার মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল তার। প্রথম আফ্রো-আমেরিকান কবি হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতিও লাভ করেন।
আফ্রিকার সেনেগাল বা গাম্বিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ফিলিস হুইটলি মাত্র আট বছর বয়সে অপহৃত হন। এরপর তাকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে নিয়ে এসে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। জন হুইটলি নামের এক মহৎ হৃদয়ের মানুষ তাকে তার স্ত্রী সুজানার পরিচারিকা হিসেবে কিনে নেন। তাকে বহনকারী জাহাজের নাম ‘ফিলিস’ এবং হুইটলি নাম মিলিয়ে জন ও সুজানা তার নাম রাখেন। ছোট্ট ফিলিস হুইটলির লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে তাকে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নেন জন ও সুজানার মেয়ে মেরি। খুব দ্রুতই তিনি লাতিন ও গ্রিক ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। সাহিত্য ও ধর্মীয় লেখাপড়ায় ছিল তার ঝোঁক। ১৪ বছর বয়সে ফিলিস লেখেন প্রথম কবিতা ‘টু দি ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ইন নিউ ইংল্যান্ড’।
১৭৬৭ সালে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রে একজন কালো মানুষ কবিতা লিখছেন এবং বই প্রকাশ করছেন, তা মেনে নেওয়ার মতো সামাজিক অবস্থা ছিল না মোটেই। ফিলিস কবিতা লেখেন এবং কবিতাগুলোর স্রষ্টা যে তিনি নিজে, তা প্রমাণের জন্য আদালতের দ্বারস্থও হতে হয়েছিল তাকে! এখানে থেকে সাহিত্যচর্চা করা হয়ে উঠবে না ভেবে হুইটলি পরিবারের সহযোগিতায় ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৭৭৩ সালে প্রথম আফ্রো-আমেরিকান নারী হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়। ‘পোয়েমস অন ভেরিয়াস সাবজেক্টস, রিলিজিয়াস অ্যান্ড মোরাল’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি সে সময় বেশ আলোড়ন তোলে। যদিও দ্বিতীয় বইটি প্রকাশের জন্য তিনি আর কোনো প্রকাশক খুঁজে পাননি।
প্রচল ভাঙার শুরু যার হাত ধরে, সেই ফিলিস হুইটলির নামে পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। বলা যায়, তার হাত ধরেই ব্ল্যাক লিটারেচার আলোর মুখ দেখেছে পরবর্তী সময়ে। তা ছাড়া তার কবিতা বিশেষভাবে জাগিয়ে তুলেছিল কৃষ্ণাঙ্গদের। শ্বেতাঙ্গ সমাজে গড়ে তুলেছিল সচেতনতা। ১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে এবং ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের অবসানের পেছনে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
এই মানুষটির শেষ সময় কেটেছে দারুণ কষ্টে। দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের পর জন পিটার নামে এক গরিব মুদি দোকানিকে বিয়ে করেন ফিলিস হুইটলি। তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও অল্প বয়সেই মারা যায় সবাই। ১৭৮৪ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে চরম দারিদ্র্য, কষ্ট আর রোগে ভুগে ফিলিস হুইটলি মৃত্যুবরণ করেন।