× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হার না মানা একজন দৃশ্য

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:১২ এএম

আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:১৩ এএম

আজোয়াত জাহান দৃশ্য

আজোয়াত জাহান দৃশ্য

সেরিব্রাল অ্যান্ড সেরিবেল্লার ডিমোলিশোন নামের বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে চলাচলের ক্ষমতা সীমিত হয়ে গেছে আজোয়াত জাহান দৃশ্য-এর। শারীরিক সেই প্রতিবন্ধকতা জয় করতে দৃশ্য বেছে নিয়েছে লেখালেখি। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবার অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার একটি রহস্যোপন্যাস। সদ্যকৈশোর পেরোনো দৃশ্যর গল্প নিয়ে আজকের লেখা...


বয়স তার সবে আঠারো পেরোল। তারুণ্যের দোরগোড়ায় পা রাখা এই বয়সি মানুষের যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কিংবা ছুটে বেড়ানোর কথা, তখন সে ঘরে বন্দি, শুয়ে-বসে কিংবা হুইলচেয়ার বা ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাচল করছে। কারণ সে বিরল এক রোগ ‘সেরিব্রাল অ্যান্ড সেরিবেল্লার ডিমোলিশোন’-এ আক্রান্ত।

মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে আসা এই তরুণের নাম আজোয়াত জাহান দৃশ্য। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্কের ‘সেরিব্রাল’ এবং ‘সেরিবেল্লার’ নামক অংশের সব স্নায়ু ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মানুষটি স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু দৃশ্য এ রোগে আক্রান্ত হয়েও হার মানেনি স্থবিরতার কাছে। মনের জোর আর ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে লেখক হওয়ার বাসনা থেকে ইতোমধ্যে লিখেছে দুটি রহস্যোপন্যাস। যার একটি ‘চম্পূ মামার গোয়েন্দাগিরি’ প্রকাশিত হয় গত বছর বইমেলায়। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আবার গোয়েন্দা চম্পূ মামা’। বই দুটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স।

আজোয়াত জাহান দৃশ্যর জন্ম ২০০৫ সালের ২০ জানুয়ারি দিনাজপুর শহরে। বর্তমানে সেখানেই বসবাস। পরিবারে আছেন বাবা সারোওয়ার জাহান বাবু, মা দিলারা বেগম ও বোন সিরাজুম মনিরা দিশা। ছোটবেলা থেকে রহস্য উদ্‌ঘাটনের নেশা থেকে গোয়েন্দা হতে চেয়েছিল দৃশ্য। ইচ্ছা ছিল, বোনের ছেলে ফাইয়াজকে নিয়ে ফেলুদা-তাপসের মতো জুটি বেঁধে গোয়েন্দাগিরি করবে। যদিও তখন দৃশ্যর বয়স মাত্র ১৩ এবং ফাইয়াজের তিন! এ বয়সে যেহেতু রহস্যের সমাধান করা সম্ভব নয়, ফলে সেই ইচ্ছা বাক্সবন্দি করে গোয়েন্দা গল্প লেখাতেই মন দিল দৃশ্য।


‘চম্পূ’ মামা নামের চরিত্রকে নিয়ে তার লেখক হওয়ার যাত্রা হয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। লিখে ফেলল গল্প ‘ঢেঁপা নদীর রহস্য’। কিন্তু ক্লাস সেভেন পড়ুয়া এক ছেলের গল্প কীভাবে নেবে পাঠক, সেই চিন্তায় গল্প তার খাতায় বন্দি হয়ে থাকে। নিজের লেখালেখি আর লেখাপড়ার মাঝে নেমে আসে বিষাদের প্রহর। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎই প্রচণ্ড উচ্চ রক্তচাপ ও কোনো এক অজানা কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আজোয়াত জাহান দৃশ্য। ভারতের বেঙ্গালুরুতে ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, দৃশ্য সেরিব্রাল অ্যান্ড সেরিবেল্লার ডিমোলিশোনে আক্রান্ত। মস্তিষ্কের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় অস্ত্রোপচার এবং দীর্ঘ দুই মাসের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসে দৃশ্য। কিন্তু চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে পুরোই ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। ডাক্তার আর বাবা-মায়ের কথার সারমর্ম বুঝতে দেরি হয় না তার। বুঝতে পারে সহসাই এ অবস্থা থেকে মুক্তি মেলার সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু স্টরয়েড ইনজেকশন ও ট্যাবলেট খেয়ে শারীরিক যন্ত্রণারও শেষ ছিল না।

এই কঠিন সময়েও মনোবল হারায়নি ছোট্ট মানুষটি। কারণ সে তো হতে চেয়েছে গোয়েন্দা। এত অল্পতে গোয়েন্দারা কি হাল ছাড়ে! হাল ছাড়েনি দৃশ্যও। সময় কাটানো এবং লেখক হওয়ার সেই বাসনা থেকে শুয়ে-বসেই লেখা শুরু করে সে। দৃশ্যের ভাষায়- ‘সেই সময়গুলোয় আসলে আমার তেমন কোনো কাজ ছিল না, তাই লিখতে শুরু করি। হাতে লিখতে পারতাম না। হাত কাঁপত। ল্যাপটপে লেখা শুরু করি। আর পড়তাম অনেক। বাবা-মা-বোন এবং আশপাশের সবাই অনেক সাহায্য করেছে।’ জানতে চাই প্রিয় লেখক কারা। উত্তরে দৃশ্য জানায়, সব বিষয়ে পড়তে আমার ভালো লাগে। তবে রহস্য ঘরানার লেখাই বেশি পছন্দ। প্রিয় লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সত্যজিৎ রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, রকিব হাসান, আগাথা ক্রিস্টি, আর্থার কোনান ডয়েলসহ আরও অনেকের লেখাই ভালো লাগে।’

শারীরিক সমস্যাকে বুড়ো আঙুল দেখানো দৃশ্যর বই করার চিন্তা কীভাবে আসে বা বই বের করার উপায় কী ছিল, জানতে চাই সে বিষয়ে। দৃশ্য জানায়, ‘অনেক ছোটবেলা থেকেই তো লিখতাম। কিন্তু সেগুলো কাউকে দেখাতে লজ্জা লাগত। আমার এক স্যার ছিলেন, সুজন বিশ্বাস। সুজন স্যারকে বলতাম। তিনি আর আমি মিলে অনেক গবেষণার পর চম্পূ মামা নামটা দিয়েছি। আর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর যখন লেখা শুরু করি, তখন আমার ফুপাতো ভাই মুসাভি রেজা অভি, অভি ভাইয়া বলত, তুই লেখালেখি চালিয়ে যা। আমি তোর লেখা বই আকারে বের করার বিষয়ে সাহায্য করব। ভাইয়াই প্রথমে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা আমার পাণ্ডুলিপি পছন্দ করে। এবং গত বছর প্রথম বইটা প্রকাশিত হয়। আর এবার তো প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই।’

বই নিয়ে সাড়া কেমন পেলে- জানতে চাই দৃশ্যর কাছে। দৃশ্যর উত্তর, ‘প্রথম বইটায় ভালো সাড়া পেয়েছি। প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। পাঞ্জেরী থেকে রয়্যালটিও পেয়েছি! এ টাকা দিয়ে আমি অনেক বই কিনেছি।’

আমাদের কথার এ পর্যায়ে জানতে চাই দৃশ্যর শরীরের বর্তমান অবস্থা। দৃশ্য জানায়, ‘এখন অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। উন্নতির দিকে বলা যায়। প্রথম প্রথম তো নড়তেই কষ্ট হতো। এখন হুইলচেয়ার আর ওয়াকারের বদলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি। ডাক্তাররা বলেছেন, আমার বয়স যেহেতু কম তাই একটা সময় আমি আবার রিকভার করতে পারব এ অবস্থা থেকে। স্বাভাবিক হতে হয়তো সময় লাগবে কিন্তু আশা ছাড়ছি না আমি।’

দৃশ্যর কথাবার্তায় এখনও কৈশোরের প্রভাব। অসুস্থ থেকেও বন্ধ হয়নি নিজের একাডেমিক লেখাপড়া। জানতে চাই সময় কাটে কীভাবে, লেখালেখির অনুপ্রেরণাই বা কী। দৃশ্যর উত্তর ছিল- ‘সময় কাটে বই পড়ে এবং লেখালেখি করে। কিছুটা সময় যায় ব্যায়ামে। আর লেখাপড়া তো করতে হয়। আমি এখন দিনাজপুরের স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ও লেভেলে পড়ছি। স্কুলে যাই মাঝেমধ্যে। এ ছাড়া স্কুলের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ তো হয় সার্বক্ষণিক। বাসায় টিচাররা এসে পড়িয়ে যান। সময় কেটে যায় এসব করেই। আর আমার অনুপ্রেরণা কিন্তু আমার অসুস্থতা। অসুস্থ হয়ে ঘরবন্দি হয়ে না পড়লে হয়তো এত তাড়াতাড়ি লেখক হয়ে উঠতে পারতাম না।’

অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে দৃশ্যর বাবা সারোওয়ার জাহান ও মা দিলারা বেগমের। কথা হয় বাবা সারোওয়ার জাহানের সঙ্গে। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার একটাই মাত্র ছেলে। এই ছেলের যখন নাম না জানা রোগে আক্রান্ত হয়ে নড়াচড়া এমনকি কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন আমাদের মানসিক অবস্থা বোঝাবার কোনো শব্দ নেই আসলে। দেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়ে বিফল হয়ে অবশেষে ভারতে যাই। সেখানে যে কত কঠিন সময় পাড়ি দিয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। দীর্ঘ দুই মাস ভারতে ছিলাম। ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে ছেলেকে নিয়ে হোটেল আর হাসপাতালে সময় কেটেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু প্রার্থনা করতাম তিনি যেন আমার সন্তানকে আবার ফিরিয়ে দেন। সেই কঠিন সময়ে আমার দুই বোন, ভগ্নিপতি ও তার এক বন্ধু আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছেন, তাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। দৃশ্য ধীরে ধীরে আবারও সুস্থ হয়ে উঠছে। সে লেখালেখি করে বই বের করে ফেলেছে, এটাতে আমরা সবাই বেশ অবাক। কারণ আমাদের বংশে এমনধারার কেউ নেই। দৃশ্যর এ সাফল্যে আমরা সবাই ব্শে খুশি।’

দৃশ্যর এ সাফল্যগাথা চলনশক্তিহীন মানুষের জন্য সত্যিই অনুপ্রেরণার। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও লেখালেখি নিয়েই। পড়তে চায় ইংরেজি কিংবা ব্যবসা বিষয়ে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে দৃশ্য আবারও নিজ পায়ে দাঁড়াবে। আর পাঠকদের উপহার দেবে নতুন নতুন চমকপ্রদ সব লেখা- এটাই হোক কামনা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা