আকিমুন রহমান
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৯ পিএম
‘আমি কি আমার ভাষাটাকে ভালোবাসি?’
আজকে নাকি এই বৃত্তান্তটাই ফকফকা স্পষ্ট করে নিতে হবে, নিজের কাছে। ভারী বিড়ম্বনাকর নয় কি বিষয়টা? ভালোবাসার তত্ত্ব-তালাশ করা কি সোজা-মোজা কোনো কর্ম! নহে নহে নয়!
আমি যদি এখন এ প্রশ্নটা আমাকে করি; কী উত্তর আসবে? আমি জানি, আমার সর্বসত্তা নিরুত্তর থাকবে। শব্দে-বন্ধে কোনো উত্তরই সে পাঠাবে না আমার দিকে। একেবারেই নয়। অন্য অনেক কটা গভীর-তীব্র বিষয় নিয়ে দু-এক বার প্রশ্ন করে দেখেছি তো। তখন দেখেছি সে স্তব্ধ হয়ে যায়। একেবারে য্যান তবদা খাইয়া যায়! কোনো একটুও সাড়া দেয় না।
একবার আমি জিজ্ঞেস করেছি; কেন আমি এমন দগ্ধ, এমন পোড়া আংড়া পোড়া আংড়া হয়ে যেতে থাকি, দাদাবাড়ির বাইরার উঠানের খড়ের গাদাটাকে ফিরে পাওয়ার বাঞ্ছা করে করে! যে-উঠান আজ কত-শত দিন হয়, লুপ্ত হয়ে গেছে। সেই বাড়ির সকল ল্যাদা-গ্যাদা ওয়ারিশগণও সেই ভিটার মায়া ছেড়েছে অনেক অনেক বছর। তাকে ভুলেও গেছে আজ অনেক অনেক কাল। শুধু আমারই কেন তাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে আর সবকিছু নিষ্ফল লাগে?
সেই কথার কোনো উত্তর আসেনি। আসেইনি!
কেন আমার অন্তরাত্মার ধরনটা এমন! দরকারের কালে সে কেন কোনো সাড়া করে না।
সে নিরুত্তর রয়ে যায়! অমন থাকে সে আগাগোড়াই; এটা সত্য। কিন্তু আমার দিকে পাঠাতে থাকে কিছু দৃশ্য। পাঠাতে থাকে হালকা-টলকা কিছু ছবি; টুকরো টুকরো। খানিকটা রঙ পাঠায়। পাঠায় কতকটা সৌরভ। কিছু অস্ফুট ধ্বনি তো পাঠায়ই!
ওই খড়ের গাদার জন্য বেতালা-বেভোলা কেন লাগে; তার জবাব দিতে নিতান্ত পরাঙ্মুখ আমার অন্তর তখন কিন্তু ঝটকার মধ্যে পাঠায়ে দিয়েছিল একমুঠো ধ্বনি। খুব মিহি, খুব নিরিবিলি, খুব অস্পষ্ট এক রকমের কান্নামোড়ানো ধ্বনি। তাকে শোনা যায় কি যায় না, তা-ও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি, সেই ধ্বনিতে কোন বাণী ঝংকার দিয়ে দিয়ে উঠছে। সেই ধ্বনিতে বেজে বেজে উঠছে কান্না! আম্মা আম্মা আম্মা! আব্বা আব্বা!
ভেসে আসছে আমার দিকে, খড়ের গাদার ধূসর মেদুর গন্ধ। সেই গন্ধের রঙ আছে। তার রঙ নিরিবিলি সন্ধ্যার মতন শ্যাম-শীতল। কবেকার সেই লঙ্কা-রক্তিম লুপ্ত ধুলোর তপ্ত-মুলাম পরশের মতো। তখন আমার আম্মার জন্য কী ক্রন্দন যে জাগে! আব্বা যে নেই, সেই না-থাকার অন্ধকারটা কী ভয়াল যে লাগতে থাকে। একা তো আছিই, তা-ও যেন আরও একা, যেন নিঃস্ব, যেন গত্যন্তরহীন হয়ে যেতে থাকি।
আজ যখন নিতান্ত জরুরি ভিত্তিতে এ প্রশ্নটা আমাকে করতে হচ্ছে; হে আমার অন্তর, বলো তো; আছে নাকি আমার কিছুমিছু ভালোবাসা, অথবা দরদ অথবা উদগ্র উচ্চণ্ড টান, এই ভাষার জন্য!
আছে?
তখন আবার কি না আমার মৌন-অন্তরাত্মা সেই অস্পষ্ট টুকরো ছবি ও গন্ধ ও রঙ-পাঠাচ্ছে আমার দিকে। সেই পুরোনোগুলোই!
তাহলে তুমি; হে আমার ভাষা, তুমি আমার আম্মার জন্য রোদনটারই তো অন্য নাম? আম্মা!
তুমি আমার আব্বার জন্য বেচয়েন হয়ে ওঠারই অন্য একটা রূপ তো? আব্বা!
এই যে আমি মান বাঙলায় বাক্য গড়তে গড়তে তোমার জন্য কাতরে উঠি; হে আমার নিত্য অষ্টপ্রহরে আম্মার মুখে বেজে ওঠা আঞ্চলিক! তোমার জন্য উতলা-বিহ্বল হতে পারি বলে, যে-নিজেকে আমার ধন্য লাগতে থাকে! তোমার অমন গহন রূপ! অমন তোমার তীব্রতা তোমার দার্ঢ্য! তোমার কাছে আসতে পেরেছি বলে আমার ধন্য লাগে, এই মানবজন্ম।
এই তুমি তবে এভাবে আমার অস্তিত্ব!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক