× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চেতনার বাতিঘর ৫ প্রকাশনী

হাসনাত মোবারক

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৯ পিএম

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪০ পিএম

চেতনার বাতিঘর ৫ প্রকাশনী

বই মানুষের চেতনা জাগ্রত করে। মলাটবদ্ধ বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসও কম ঋদ্ধ নয়। স্বাধিকার আন্দোলন এবং আমাদের সংস্কৃতির বাতিঘর হয়ে কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। 

নওরোজ কিতাবিস্তান : আশি বছরের দোরগোড়ায় 

১৯৪৪ সালে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী এবং তার বন্ধু আইনুল হক খান কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবযুগ লাইব্রেরী’। পরে কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া নাম নিয়ে এই লাইব্রেরির নাম হয় ‘নওরোজ লাইব্রেরী’। ১৯৪৮ সালে ঢাকার বাংলাবাজারে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’। বিকাশমান এই প্রকাশনার দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিকের বই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে।

১৯৮৪ সালে মোহাম্মদ নাসির আলীর মৃত্যুর পরে তার বংশধরদের সঙ্গে নওরোজ কিতাবিস্তান ভাগাভাগি হয়ে মূল প্রতিষ্ঠানের একক মালিকানা পান আব্দুল কাদির খান। ২০০০ সালে আবদুল কাদির খান মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন বর্তমান স্বত্বাধিকারী মনজুর খান চৌধুরী। উল্লেখ্য, আব্দুল কাদির খান সম্পর্কে তার খালু হন। নওরোজ কিতাবিস্তানের অধীনে প্রায় ৩ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। ৭৯ বছরের পুরোনো এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বত্বাধিকারী বলেন, বর্তমানে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালানোর অনেক প্রতিবন্ধকতা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রকাশনার খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার কাগজের দামও আকাশচুম্বী। এ ছাড়াও বইয়ের প্রকাশনার কাজ করার মতো দক্ষ কর্মীর অভাবও রয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায়, ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নতুন ৮টি বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ ছাড়াও আগের অন্যান্য বইও থাকবে পাঠকদের জন্য। 

আগের সেই জৌলুস না থাকলেও একটা সময় কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো, আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ এবং সত্যজিৎ রায়ের রচনাবলিসহ অনেক পাঠকপ্রিয় বই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে।

মাওলা ব্রাদার্স : ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী

আজ থেকে সাত দশক আগে ১৯৫৪ সালে ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক খান বাহাদুর জিয়াউল হকের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাওলা ব্রাদার্স। সেই সময় শিক্ষামূলক বইয়ের চাহিদা ছিল অনেক, সেই চাহিদা মেটাতেই মূলত এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। পরবর্তী সময়ে তার কনিষ্ঠ পুত্র আহমেদ আতিকুল মাওলা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে সৃজনশীল বই প্রকাশে মন দেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৬১ সালে সৈয়দ শামসুল হকের ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘অনুপম দিন’ ও আবদুশ শাকুরের ‘ক্ষীয়মাণ’। কনিষ্ঠ পুত্র আহমেদ আতিকুল মাওলার মৃত্যুর পরে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন তারই ভাইয়ের ছেলে আহমেদ মাহমুদুল হক।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার দাদার পরে ছোট চাচার হাত ধরে সৃজনশীল প্রকাশনায় নাম লেখায় মাওলা ব্রাদার্স। তার মৃত্যুর পরে আমার বড় ভাই কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করলেও এরপর দায়িত্ব নেই আমি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে দায়িত্বে আছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি সৃজনশীল ও মনননশীল বই প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের পাঠের ক্ষুধা মেটাতে। এবারের বইমেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাগজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার বই প্রকাশ করা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ বছর ৫৫টি বই প্রকাশের চিন্তা আছে আমাদের। জানি না শেষ পর্যন্ত কয়টি বই প্রকাশ করতে পারি। এবার আমাদের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছেÑ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের ‘শতাব্দীর আত্মকহন’, কাবেদুল ইসলামের ‘বাংলাদেশের সংবিধান : জন্মকথা’, মুনতাসির মামুনের ‘আদর্শ, রাষ্ট্র, রাজনীতি : মুসলিম লীগের অবসান ও আওয়ামী লীগের উত্থান’, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘শরণার্থীর সুবর্ণরেখা’, রুশ ভাষা থেকে মশিউল আলমের অনুবাদে দস্তয়ভস্কির ‘নিরীহ’সহ আরও কিছু বই।

স্টুডেন্ট ওয়েজ : সাত দশক পেরিয়ে 

বাংলাদেশের প্রকাশনার অন্যতম পুরোধা প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজ। আজ থেকে সাত দশক আগে আলহাজ মো. হাবিবউল্লাহ ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই প্রকাশনা সংস্থা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশনা জগতে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। মোহাম্মদ হাবিবউল্লাহর হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটির এক সময় গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তারই পুত্র মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ। স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্যা, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, চিকিৎসা, জীবনী, সঙ্গীত, কিশোরসাহিত্যসহ অসংখ্য রেফারেন্স বই। শুরু থেকে পাঠকের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে বর্তমানেও এগিয়ে চলছে এই প্রকাশনাটি। 

একটা সময় এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাবাজারের কার্যালয়টি ছিল লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল। স্টুডেন্ট ওয়েজ একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী বইয়ের সুনির্বাচিত সংগ্রহ প্রকাশ করেছে, তেমনি ১৯৬৮ সালে বৈরী পাকিস্তানি পরিবেশে আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের ঐতিহাসিক সংকলন প্রকাশ করে বাঙালি সংস্কৃতি সুরক্ষার আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলি, মুহাম্মদ আবদুল হাইয়ের ‘বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’-এর মতো কালজয়ী বইয়ের প্রকাশক ছিলেন লিয়াকতউল্লাহ। তার মৃত্যুর পর বংশপরম্পরায় এখন এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন তার পুত্র মাশফিকউল্লাহ তন্ময়। বর্তমান ব্যস্ততা ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে তন্ময় বলেন, ‘বইমেলার ব্যস্ততায় আছি এখন। বাবার পরে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেছি। পাঠকদের ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে যাব। অন্যান্যবারের মতো এবারও বেশ কিছু বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য বইও থাকবে।’

মুক্তধারা : বইমেলার সঙ্গে যুক্ত যার ইতিহাস

অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাসের সঙ্গে যে মানুষটির নামটি জড়িয়ে আছে, তিনি মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশের অনেকে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। চিত্তরঞ্জন সাহাও পাড়ি জমিয়েছিলেন সেখানে। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’। সেই ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ থেকে জন্ম নেয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা। কলকাতার পার্ক সার্কাসের পাম এভিনিউয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী বাসায় থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের বরেণ্য সাহিত্যিকদের রচিত তেত্রিশটি বই প্রকাশ করে মুক্তধারা। মুক্তধারার প্রথম গ্রন্থের নাম আহমদ ছফার ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। 

১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত “একুশের” অনুষ্ঠানে মুক্তধারা তার তেত্রিশটি বই বাংলা একাডেমি চত্তরের মধ্যে চট বিছিয়ে প্রদর্শনী ও বিক্রয় এর ব্যবস্থা করে। এই কাজে তাঁকে সর্বোত ভাবে সহযোগীতা করেন বর্তমান পুথিঘর লিঃ ও মুক্তধারার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক জহর লাল সাহা। তিনি পর্দার অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোলকাতা থেকে মুক্তধারার বই প্রকাশের সাথেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে সাহিত্য সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে মুক্তধারা একটা স্টল তৈরি করে। ১৯৭৫ সালে কয়েকজন প্রকাশক মুক্তধারার সঙ্গে বাংলা একাডেমিতে বইয়ের স্টল দেন। এভাবেই তার দেখানো পথ ধরে শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। 

জহর লাল সাহার সঙ্গে কথা হয় মুক্তধারার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। শুরু থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বর্তমানে আগের মতো সময় দিতে পারছেন না। তিনি জানান, মুক্তধারার দায়িত্বে ছিলেন সজীব সাহা। ২০২০ সালে প্যান্ডামিকে সজীব সাহা মারা যান। এখন পরিচালনা করছেন রাজিব সাহা। ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, সজীব আমার ছোট ছেলে। ওর নামে শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তনের পরিকল্পনা রয়েছে। এবারের বইমেলাকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোর উপযোগী নতুন দুটি বই প্রকাশিত হচ্ছে।

খান ব্রাদার্স : অনেক প্রথমের এক প্রকাশনা

প্রকাশনা সংস্থা খান ব্রাদার্স। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে মিশে আছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরক’-এর প্রকাশের ইতিহাস। এই প্রতিষ্ঠান থেকে হুমায়ূন আহমেদের ৮টি বই প্রকাশ হয়েছে। বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিক সত্যেন সেনের ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’, ‘মনোরমা মাসিমা’সহ অন্যান্য বইয়ের প্রকাশক ছিল খান ব্রাদার্স। রণেশ দাশগুপ্ত ও সাহিত্যিক আহমদ ছফারও বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে।

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান স্বত্বাধিকারী কেএম ফিরোজ খানের কাছে তার প্রকাশনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে আমার বাবা মোহাম্মদ মোসলেম খান এই প্রকাশনা চালু করেন। বাবার সাহায্যকারী হিসেবে আমার বড় ভাই কেএম ফারুক খান ও আমি শুরু থেকেই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত আছি। বর্তমানে আমার বয়স ৭৫ বছর। অনেক কাজ করেছি। এবার দায়িত্ব অন্য কারও হাতে তুলে দিতে চাই। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রকাশনা শিল্পেও মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পড়ছে। এবারের বইমেলায় ৩টি নতুন বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

৫৬ বছরের ইতিহাসে প্রায় ১০০০ বই প্রকাশ করেছে খান ব্রাদার্স। এ ছাড়াও অনেক কবি ও সাহিত্যিকের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে। যার মধ্যে অন্যতম রফিক আজাদের ‘অসম্ভবের পায়ে’, হুমায়ুন কবীরের ‘কুসুমিত ইস্পাত’, হুমায়ুন আজাদের ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, মহাদেব সাহার ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’, আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে’ এবং নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা