মৌসুম আহমেদ
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:২৩ পিএম
ছয় তারের যন্ত্র গিটার। এই সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের সব সমস্যার সমাধানই আছে তার কাছে। ফলে তাকে গিটার ডাক্তার হিসেবেই চেনে লোকে! শুনতে অবাক লাগলেও, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে গিটার সারাইয়ের কাজ করে আসছেন তিনি। বলছি বাদ্যযন্ত্রের মেকানিক আব্দুল রফিকের কথা।
বয়স ৬৫ ছুঁইছুঁই। জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটেছে তার গিটারের ছয় তারের সঙ্গে। বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা গিটারের যেকোনো সমস্যায় আসতেন আব্দুল রফিকের কাছে। তার কাছে আসতেন আইয়ুব বাচ্চু, লাকি আখন্দ, শাফিন আহমেদ, জেমসের মতো শিল্পীরা। তারাই তাকে নাম দিয়েছেন গিটার ডাক্তার।
রাজধানীর সাইন্সল্যাব মোড়ের কলেজ স্ট্রিটের ছোট্ট একটি দোকান, এখানেই বসেন আব্দুল রফিক। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে চশমা আর মুখে মিষ্টি হাসিতে কথা বলেন তিনি। এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হওয়ার কথা ভাবেননি কখনও। কারণ ছয় তারের এ যন্ত্রেই খুঁজে পান পৃথিবীর সব শান্তি। বছরখানেক আগে মারা গেছেন তার প্রিয় সহধর্মিণী। সেই শোক মনে পুষে রেখেও নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
এ দোকানেই কখনও কখনও তারকারা অপেক্ষা করেছেন গিটারের জন্য। এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও দিন শেষে আসেন এখানেই। কারণ তিনি যে গিটারের ডাক্তার। তাকে ছাড়া এ প্রজন্মও যেন সত্যিই অচল।
রফিক বলেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে আমি ইলেকট্রনিক্স সারাইয়ের কাজ করি। কিন্তু গিটার ঠিক করার কাজে আসা ১৯৮০ সালের দিকে। সেই থেকে এখনও এ কাজে আছি। দেশের প্রায় সব লিজেন্ড শিল্পী এসেছেন তাদের গিটার নিয়ে আমার কাছে।’
হাজারো যন্ত্রের ভিড়ে ছোট্ট একটি টেবিলে বসে আপন মনে কাজ করে যান আব্দুল রফিক। নষ্ট গিটারও তার হাতে পড়ে টুংটাং শব্দে বেজে ওঠে সঠিক সুরে। প্রায় সারা দিনই ভিড় লেগে থাকে দোকানে। হাসিমুখে কথা বলেন সবার সঙ্গে। তার কাছে সব সমস্যারই যেন সমাধান আছে। জাদুর হাতের ছোঁয়ায় সেগুলো সারিয়ে তোলেন তিনি। এখানে আসা এক তরুণ বলেন, ‘উনি অনেক ভালো মানুষ। তার কাছে গিটার নিয়ে এলে সব সমস্যা সমাধান করে দেন। একদম নিশ্চিন্তে থাকা যায়। তার কাছে এলে আগে চা দেন। নিজের অনেক কথা শেয়ার করেন আমাদের সঙ্গে। খুব ভালো লাগে তার এমন ব্যবহার। আমরা বন্ধুরা কখনও কখনও কাজ ছাড়াও এসে আড্ডা দিয়ে যাই তার সঙ্গে।’
যে কাজ শিখেছেন আব্দুল রফিক, দীর্ঘ সময়ে তা শিখিয়েছেন অনেক মানুষকে। তার হাতে গড়া শিষ্যের সংখ্যা ২০-এর বেশি। অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর এক ছেলে, এক মেয়ে ও গিটার নিয়েই আছেন তিনি। নিজে মেকানিক হয়েও কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তুলেছেন। আব্দুল রফিক জানান, মেয়ে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স আর ছেলে আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি থেকে আইপিইতে পড়ালেখা শেষ করেছে।
বয়সের কারণে শরীরে তার ভর করেছে নানান ব্যাধি। কিন্তু গিটারের মায়া ছাড়তে পারেননি এখনও। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে চান মায়ার এই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে, ছয় তারের সুরের সঙ্গে; এমনটাই তার আশা।