মাসুম মাহমুদ
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫ ১৪:২৯ পিএম
অলংকরণ : মিথিলা ভৌমিক। সে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী
প্রিয় বাবা,
বারান্দায় বসে ভাবছিলাম তোমাকে চিঠি লিখব। তখনই অনেকটা কুয়াশার মতো দেখতে নীলচে ধূসর রঙা মেঘ এসে হাজির। প্রথমে ভেবেছি, মেঘ বুঝি কিছু বলবে। অথচ সূর্যের আলো এসে বলল, ‘মেঘ প্রায় পুরো আকাশ ঢেকে রাখলেও সূর্যের আলো মেঘভেদ করে ঠিকই আসতে পারে। চিঠিতে লিখো, বাবাও সূর্যের আলোর মতো, সন্তানের জীবনে আলো হয়ে দেখা দেন।’
তারপর এলো বৃষ্টি। সাঁইসাঁই করে এসে বলল, ‘শুনেছি বাবার কাছে চিঠি লিখবে! চিঠিতে বৃষ্টির, মানে আমাদের কথাও লিখো। বৃষ্টি মানে জানো তো! প্রকৃতির এক মধুর ছোঁয়া। বৃষ্টির ছোঁয়ায় সবুজরা প্রাণ পায়, মাটি হয়ে উঠে সজীব, সতেজ। বাবাকে বলো সে বৃষ্টির মতোই। তার স্পর্শ, আদর সন্তানের মেধা ও সুস্থ শরীরের জন্য চমৎকার ফিকির হিসেবে কাজ করে।’
বৃষ্টি চলে গেলে দাদির কথা মনে পড়ল। নিশ্চয় দাদি ওদের বলেছে তোমাকে চিঠি লিখব এ কথা। নইলে কি! দাদি ছাড়া কাউকে আমি চিঠির কথা বলিইনি। সঙ্গে সঙ্গে দাদিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবাকে চিঠি লিখব, তুমি বলেছ ওদের?’
‘কাদের কথা বলছিস!’
‘সূর্যের আলো, বৃষ্টি ওদের।’
‘এমা! আমি কেন বলতে যাব! ওরাই তো চারদিক থেকে তোর বাবাকে ঘিরে রাখে, দেখো! চিঠির কথা তোর বাবাই হয়তো বলেছে ওদের।’
অবাক হয়ে দাদিকে জিজ্ঞেস করি, ‘মেঘ, বৃষ্টি, সূর্য, ওরা সত্যিই বাবাকে ঘিরে থাকে?’
আমায় সঙ্গে নিয়ে দাদি জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। অদূরে একটা পাখি ওড়ে যাচ্ছে। পাখিটা দেখিয়ে দাদি বলল, ‘ওই যে পাখিটা ওড়ছে দেখছিস! সেও তোর বাবার চারপাশেই ওড়ে।’
এই বলে দাদি চলে গেল। পাখিটা শূন্যে মিলিয়ে গেলে মাটিতে তাকাই। দেখি একটা ফুল জানালায় উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেবলই হওয়া বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু সে। চোখে চোখ পড়তেই বলল, ‘দাদি ঠিকই বলেছে, চারদিক থেকে আমরাই তোমার বাবাকে ঘিরে রাখি। তাই বলে বাবা কিন্তু চিঠির কথা বলেনি আমাদের। সুন্দর মনের কথা আমরা বুঝতে পারি। তোমার মনের কথাও বুঝতে পেরেছি। ও হ্যাঁ! বাবাকে লেখা চিঠিতে ফুলের কথা লিখতে ভুলো না যেন! লিখবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলোর মধ্যে ফুল একটি। বাবাও ফুলের মতন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একজন।’
কী সুন্দর করে বলল ফুল। কিছুক্ষণ চোখ ভরে ফুলটাকে দেখি। মনে হচ্ছিল তোমাকেই দেখছিলাম, বাবা। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বাড়ির আঙিনায় তোমার হাতে রোপণ করা গাছটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তুমি বলতে কড়ই গাছ, মা বলেছেন আসলে ওটা শিরীষগাছ। মনে হচ্ছিল ও গাছেরও কিছু বলার আছে। কাছে গিয়ে দেখি শিরীষ ফুলে ভরে আছে গাছ। আমায় দেখেই বলল, ‘গাছ কত ঝড়, বন্যা, খরার কবলে পড়ে জানো! তবু গাছেরা টিকে থাকে। প্রকৃতিতে লড়াই করেই গাছেদের নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়। বাবাও গাছের মতন। হাজারো ঝড়, খরা সামলে সন্তানের আগামী সুন্দর জীবনের জন্য, কল্যাণের জন্য বাবাকেও লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। চিঠিতে লিখো সব। বল, গাছ লিখতে বলেছে।’
এই গাছ, ফুল, মেঘ, বৃষ্টি তুমিই চিনিয়েছ আমায়, বাবা। ওদের সঙ্গে কথা বলতে শিখিয়েছ। ওদের কথা শুনে শুনে নদীকে মনে পড়ল খুব। আমাদের কালী নদী। তোমার হাত ধরেই প্রথম গিয়েছিলাম ও নদীর কাছে। তোমায় চিঠি লিখব আর নদী কিছু বলবে না, তা কী করে হয়! নিশ্চয় নদীরও কিছু বলার আছেÑ ভাবতে ভাবতে কালী নদীর পাড়ে যাই। গিয়ে দেখি ঘাটে বাঁধা কতগুলো নৌকা আমাদের বাড়ির আমগাছের মগডালে বসা সারি সারি বকের মতো নীরবে বসে আছে। আমায় কাছে পেয়ে শান্ত নদীটা তার চিরাচরিত স্বভাবে কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘চিঠিতে লিখবে-বাবা তুমি নদীর মতো। চিরকালের সৌন্দর্য তোমার। বর্ষার পানিতে নদী যেমন তার শ্রেষ্ঠ সময় ফিরে পায়, তেমনি সন্তানের সান্নিধ্যে বাবা কাটায় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর মুহূর্ত।’
ওরা যা যা বলল চিঠিতে সবই লিখলাম তোমায়, বাবা। একটাই আফসোস রয়ে গেল শুধু। পাহাড়ের কাছে যাওয়া হলো না। নিশ্চয় তারও কিছু বলার ছিল তোমায় নিয়ে। পাহাড় নিশ্চয় এটাই বলতÑ বাবাকে বল সে পাহাড়ের মতো। আমিও তাই বলি বাবা, তুমি সত্যিই পাহাড়ের মতো। আমার মাউন্ট এভারেস্ট।
ইতি
তোমার ছোট পাহাড়