জান্নাতুল ফেরদৌস স্নিগ্ধা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫ ১২:৪৯ পিএম
জনতার মাঝে নির্জনতা উপভোগ করতে চাইলে নেপালের থামেলে আপনাকে স্বাগতম। এটা এমন স্থান, যেখানে কোলাহলই আপনাকে নিঃশব্দ চিন্তায় ডুবিয়ে দেবে। চারপাশে পর্যটকের ভিড়, দোকানদারের ডাক, ধর্মঘণ্টার মৃদু ধ্বনি; তবু কোথাও যেন এক অদ্ভুত নীরবতা কাজ করে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। থামেল এমনই এক জায়গা, যেখানে হাঁটতে হাঁটতে আপনি নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজেও পাবেন।
নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থামেল এলাকার দূরত্ব মাত্র ৫-৬ কিলোমিটার। এ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হলো Pathao এবং inDrive অ্যাপ ব্যবহার করা। বিমানবন্দর থেকেই নেপালি সিমকার্ড সংগ্রহ করে নিলে গোটা ভ্রমণটাই হয়ে উঠবে আরও সহজ। সিম কিনতে হলে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয় এবং পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি জমা দিতে হয়। যদি ছবি সঙ্গে না থাকে, তাহলে মাত্র ৫০ রুপিতে সেখানেই ছবি তুলে নেওয়ার সুবিধা রয়েছে। ২০ জিবি ইন্টারনেট ও টকটাইমসহ ৬০০ রুপিতে সিম পেয়ে যাবেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি থামেল যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া সাধারণত পড়ে ৮০০-১,০০০ রুপি। কিন্তু inDrive অ্যাপ ব্যবহার করলে একই গন্তব্যে পৌঁছাতে খরচ হতে পারে মাত্র ৫০০ রুপিরও কম। এই কয়েকটি ছোট্ট প্রস্তুতি নিলেই নেপাল ভ্রমণ হবে ঝামেলাবিহীন এবং আরও সাশ্রয়ী।
গাড়ি যখন এগিয়ে চলে ব্যস্ত শহরের মধ্য দিয়ে, কখনও চোখে পড়ে উজ্জ্বল রঙের বাস, কখনও ঠেলাগাড়ি কিংবা সারি সারি স্কুলপড়ুয়া শিশুদের পদচারণা। সবকিছুতেই যেন ঢাকা শহরের পরিচিত ছায়া। তবে হঠাৎই দৃশ্যপটে আসে সিল্ক ওক আর জাকারান্ডা গাছের হলুদ ও বেগুনি ফুলের এক অনন্য প্রতিযোগিতা- আকাশ ছুঁতে চাওয়া রঙের উল্লাস। সেই রঙিন মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়, আমি আর নিজের দেশে নেই; আছি এক স্বপ্নঘেরা, ভিন্ন বাস্তবতায় ঘেরা কোনো অপরিচিত সুন্দর দেশে।
প্রথমবার থামেলে পা রাখতেই চোখে পড়ে রঙিন প্রার্থনা পতাকা, সরু অলিগলি, কাঠের খোদাই করা জানালা আর গলির পর গলি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হস্তশিল্পের দোকান। প্রথম নজরে থামেল আমার কাছে এক রঙিন বাজার বলে মনে হয়েছিল, যেখানে পাওয়া যায় হাজার রকম জিনিস। সুন্দর, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পথের মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে ছোট-বড় মন্দির, যেখানে দিনের সব সময়ই জ্বলে থাকে প্রদীপ। সন্ধ্যা নামতেই অলস ঠান্ডা এসে জড়িয়ে ধরে শহরটাকে, আর চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে। ধীরে ধীরে চারপাশে আলো জ্বলে ওঠে, বাতাসে ভেসে আসে ধূপের মিষ্টি গন্ধ। মনে হয়, যেন শহরটা ঘুম থেকে জেগে উঠল- শুধু আলো আর গন্ধে নয়, মানুষের গমগম শব্দে, তাদের হাঁটার ছন্দে।
রাতের থামেল হয়ে ওঠে আরেক জগৎ। কেউ ব্যস্ত নেপালি পণ্য কেনাকাটায়, কেউ রেস্তোরাঁয় বসে মোমো চোখে দেখছেন, আবার কেউ ঘুরছেন ধূপের স্টল, পাথরের গয়না কিংবা তিব্বতি থাঙ্কা পেইন্টিংয়ের দোকানে। অনেক ভ্রমণকারী অন্নপূর্ণা কিংবা অন্যান্য দুর্গম পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি নিতে থামেল থেকেই প্রয়োজনীয় পোশাক, জুতা কিংবা ট্রেকিং টুলস কিনে নেন বা ভাড়া করেন। আবার কেউ কেউ পাহাড় থেকে দীর্ঘ ট্রেক শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসেন এই শহরে- বিশ্রামের জন্য, শান্ত কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে দেশে ফেরার আগে।
এই শহরের প্রতিটি কোনায় কোনো না কোনো গল্প লুকিয়ে আছে। আমার কাছে সে গল্পগুলো ধরা দেয় যেন নতুন এক রূপকথার মতো, কারণ এই শহরের বাস্তবতা আমার চেনা পৃথিবী থেকে একেবারে আলাদা। যেমন- শহরজুড়ে দুলতে থাকা প্রার্থনার পতাকাগুলো। গাছের ডালে, ছাদের ওপর এমনকি পাহাড়ি পথ ধরেও এগুলো টানানো থাকে। শুধু সৌন্দর্যই নয়, এর প্রতিটি রঙের আলাদা তাৎপর্য আছেÑ নীল আকাশ, সাদা বাতাস, লাল আগুন, সবুজ পানি আর হলুদ মাটি। পতাকায় ছাপা প্রার্থনাগুলো বাতাসে ভেসে মঙ্গল ও করুণা ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। এখানে প্রতিটি প্রতীক এমনকি গয়নার একটি একটি পুঁতিও যেন কিছু বলার চেষ্টা করে। যেমন- এই শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা দোকানে পাওয়া যায় নানান ধরনের ঐতিহ্যবাহী অলংকার, যার প্রতিটিতেই লুকিয়ে আছে সংস্কৃতির একটুকরো গল্প। তেমনই একটি গহনা হলো তিলহারি (Tilahari), নেপালের বিবাহিত হিন্দু নারীদের একটি পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অলংকার। তিলহারি সাধারণত লাল বা সবুজ কাচের পুঁতির তৈরি লম্বা মালা। এই মালার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে একটি সোনার পাতি বা পেনডেন্ট; যা অনেক সময় পাতা বা গুটির মতো আকৃতির হয়, আর তার নকশায় থাকে সূক্ষ্ম কারুকার্য। শুধু অলংকার হিসেবে নয়, তিলহারি একজন নারীর জীবনের এক অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে- একটি সম্পর্কের, একটি দায়িত্বের এবং এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারীর।
কিন্তু থামেলের আসল সৌন্দর্যটা আমি খুঁজে পেয়েছি এর বৈপরীত্যে ভরা ছন্দে। অনেক অমিল এখানে এমনভাবে একত্রে জুড়ে গেছে, যেন এক অপূর্ব সুর বুনে উঠেছে। একই রাস্তার একপাশে কেউ হাতে বোনা নেপালি কার্পেট বিক্রি করছেন, আর অন্য পাশে ইউরোপিয়ান গানের দল প্রাণভরে গাইছে। কোথাও কোনো বৌদ্ধমন্দিরে শান্ত ঘণ্টাধ্বনি, আবার পাশের কোনো ক্যাফে থেকে ভেসে আসছে হালকা জ্যাজ সুর।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কেউ, কাঁধে রুকস্যাক আর আরেক কোনায় বসে কেউ নীরবে বই পড়ছেন। যদি বই হয় আপনার ভালোবাসা, তাহলে থামেলের Pilgrims Book House আপনার জন্য এক নির্ভুল গন্তব্য। প্রায় চার তলাবিশিষ্ট এই স্থাপনা শুধু একটি বইয়ের দোকান নয়, এটি যেন একটা জাদুঘর। নেপালের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যা কিছু সময়কে অতিক্রম করে এসেছে, তার এক নিখুঁত প্রতিফলন দেখা যায় এখানে। বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছাড়াও এখানে রয়েছে হাতে আঁকা চিত্রকর্ম, প্রাকৃতিক পাথরের দুর্লভ সংগ্রহ, দেব-দেবীর মূর্তি, কাঠের খোদাই করা খেলনা এবং নানান ধরনের নেপালি হস্তশিল্প। নেপাল সম্পর্কে যত ‘কেন, কখন, কীভাবে’- সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো বইয়ের পাতায়, আপনার জন্য অপেক্ষায়। জ্ঞান ও শিল্পের এমন সম্মিলন বিরল। তাই থামেলে পা রাখলে Pilgrims Book House ঘুরে দেখা একান্ত জরুরি।
ছোট্ট থামেল ঘুরে দেখতে হলে হেঁটেই চলতে হয়। আর এই হেঁটে চলার মধ্যেই একে একে চোখে পড়ে স্ট্রিট ফুড, শত শত রেস্টুরেন্ট, কফি শপ আর পাব- এ যেন এক চলমান উৎসব। আমার মনে হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের খাবারই এখানে কোনো না কোনো রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায়। তবে মুসলমান ভ্রমণকারীদের জন্য হালাল খাবার খুঁজে পেতে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হতে পারে, আর খাবারের অপশনও তুলনামূলকভাবে সীমিত। হালাল খাবারের জন্য থামেলের অমরিত মার্গ রোডে অবস্থিত বিসমিল্লাহ হালাল রেস্টুরেন্ট হতে পারে একটি চমৎকার গন্তব্য। কাবাব, বিরিয়ানি কিংবা কাচ্চির স্বাদ নিতে এখানে নিশ্চিন্তে আসা যায়। এ ছাড়া গাহিটি রোডে রয়েছে আল মদিনা রেস্টুরেন্ট, যা হালাল খাবারের আরও একটি নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। একটি কথা খেয়াল রাখা জরুরি, এখানে সফট ড্রিংক বা বেভারেজের দাম তুলনামূলক বেশি, তাই অর্ডার দেওয়ার আগে দাম দেখে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে সব রকম খাবার পাওয়া যায়, শুধু খুঁজে নিতে হয়। আর খুঁজতে গিয়ে যদি কখনও হারিয়েও যান, ভয় নেই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- এই শহরে হারিয়ে গেলে পথ নিজেই ধরা দেয়, ঠিক যেমন কোনো গল্পের চরিত্র নিজেই তার ভাগ্য আবিষ্কার করে।
গৌতম বুদ্ধ আমার কাছে গল্পের চরিত্রের মতো। কোনো এক বটতলার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে নিতে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল- এই নেপালই তো গৌতম বুদ্ধের জন্মভূমি। সেই মহাপুরুষ, যিনি কোনো এক জোছনাভরা রাতে ত্যাগ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, সংসার আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। বসন্তকালে এই শহরের বাড়িঘর এতটাই রঙিন, পরিপাটি আর জীবন্ত যে মনে হয়, যেন বসন্তের রঙে আঁকা কোনো স্বপ্নের শহর। তখনই মনে প্রশ্ন জাগেÑ এমন মায়াবী রঙের ঘরের টান কীভাবে উপেক্ষা করলেন সিদ্ধার্থ? কীভাবে ত্যাগ করলেন সবকিছু? আমি জানি না। তারা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছিলাম, ‘বাংলার বাতাসে নাকি বৈরাগ্য আছে।’ তবুও ভাবি, মানুষ আসলে কীসের টানে ঘর ছাড়ে? কোন তৃষ্ণা তাকে টানে অচেনা পথে? এই শহরের অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখি, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ভিড়; তখন মনে হয়Ñ এ শুধু ভ্রমণ নয়, যেন এক অজানা অনুসন্ধান। কেউ একা হাঁটছে, কেউ দলবেঁধে এসেছে, কিন্তু কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। রাস্তাজুড়ে মানুষ অথচ কোথাও কোনো কোলাহল নেই; আছে শুধু হাসি, গল্প আর এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মনে হয়, কেউ জানে না সে কোথায় যাচ্ছে বা কী খুঁজছে; ঠিক যেমন আমিও জানি না। তবু সবাই চলেছে, হেঁটে চলেছে। উপভোগ করছে এই চলাটাকেই। এই অনিশ্চিত পথই কি তবে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য? হয়তো তাই।
থামেল এমন এক স্থান, যেখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। গন্তব্য নয়, এই পথচলাই হয়ে ওঠে দর্শনের মতো, কখনও রঙিন প্রার্থনা পতাকায়, কখনও কাঠের খোদাই করা জানালায়, আবার কখনও এক কাপ চায়ের ধোঁয়ায় ভেসে ওঠে জীবনের নির্জন সত্য।