রওনক জাহান পুষ্প
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ১৩:০৭ পিএম
বৃষ্টিধারায় মুগ্ধতা মডেল : মৃন্ময়ী দাস তিথী, ছবি : আজরাক আল রেজওয়ান
ফ্যাশনপ্রেমী, তরুণ-তরুণী ও কবি-সাহিত্যিকদের কাছে বর্ষার আবেদন আলাদা। রঙ-বেরঙের ছাতা নিয়ে হুটহাট বৃষ্টিতে নেমে পড়া, চায়ের সঙ্গে মুচমুচে পেঁয়াজু অথবা খিচুড়ি-ভর্তা-ভাজির আবেদন, পাতলা কাঁথার নিচে আরাম করে ঘুমানোর সঙ্গে সঙ্গে বর্ষায় ফ্যাশনেও আসে নতুন রূপ। বর্ষার ফ্যাশনে মূলত নীল রঙই প্রাধান্য পায়। নীল রঙকে আমরা সব সময় বর্ষা ও পানির সঙ্গে মেলাই। নদী বা সমুদ্র আঁকার সময় যেমন নীল রঙটাই হাতে উঠে আসে, তেমনই বৃষ্টিবিলাসে মন নীল রঙটাকেই যেন বেশি পছন্দ করে। অবশ্য নীলের বাইরে সাদা, কমলা, হলুদ, লাল, হালকা গোলাপি রঙও বর্ষার আবেদনকে বাড়িয়ে দেয়। বর্ষা শুধু মনই ভিজিয়ে দেয় না, সঙ্গে একে ঘিরে থাকে নানা আয়োজন, পোশাকে আসে নতুন নতুন ডিজাইন, তৈরি হয় ফ্যাশনের সমাহার।
কেমন পোশাক চাই
বর্ষা মানেই সময়-অসময়ে রিমঝিম বৃষ্টি। তাই পোশাক হতে হবে এমন, যা ভিজে গেলেও দ্রুত শুকিয়ে যায়। জর্জেট, পাতলা সিল্ক, মিক্সড কটন, কটন, ভিসকস ধরনের কাপড় এ আবহাওয়ার উপযোগী। সিনথেটিক কাপড়ের পোশাকগুলোও এ ঋতুতে বেশ আরামদায়ক। মোটা বা ভারী কাপড় এড়িয়ে চলাই ভালো। আঁটসাঁট পোশাক ভিজে গেলে শরীরের সঙ্গে লেগে থেকে ঠান্ডায় অস্বস্তির কারণ হতে পারে, তাই বর্ষায় ঢিলেঢালা পোশাক বেছে নেওয়াই ভালো। রঙ হিসেবে আমরা বর্ষার সঙ্গে সব সময় নীলকেই বেছে নেই, তাই হালকা থেকে গাঢ় বিভিন্ন শেডের নীল হতে পারে আপনার পছন্দ। তবে লাল, কমলা, হলুদ বা গোলাপির মতো উজ্জ্বল রঙও বেছে নিতে পারেন। এই রঙ সহজেই নজর কাড়ে।
৩০ বছর ধরে দেশীয় সংস্কৃতিকে ফ্যাশনের মাধ্যমে তুলে ধরছে ফ্যাশন হাউস ‘বিশ্বরঙ বাই বিপ্লব সাহা’। তারই ধারাবাহিকতায় এই বর্ষায় ২০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বরঙ-এ চলছে নীল উৎসব। বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস, ফতুয়া, কামিজ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি দেশীয়, ওয়েস্টার্ন ও ফিউশন সব ধরনের পোশাকই থাকছে এ উৎসবে, রঙে অবশ্যই প্রাধান্য পাচ্ছে নীল। নীল ও সাদাকে গুরুত্ব দিয়ে টাই-ডাই, ব্লক, বাটিক, স্ক্রিনপ্রিন্ট, কাটওয়ার্ক এবং এপ্লিক মাধ্যমে করা হয়েছে বিভিন্ন ডিজাইন, যেগুলো মন কেড়ে নেবে। বিশ্বরঙ-এর সব শোরুমেই চলছে এই নীল উৎসব।
এ ছাড়াও বিশেষভাবে বর্ষাকেই মাথায় রেখে কদমফুলের থিমে নতুন কালেকশন নিয়ে এসেছে ‘রঙ বাংলাদেশ’। দেশের অন্যতম পরিচিত এই ফ্যাশন হাউসে এবার বর্ষার নতুন আয়োজনে রয়েছে সব বয়সিদের জন্য পোশাক। বর্ষা এলেই আমাদের মন জয় করে নেয় কদম ফুল, হালকা মিষ্টি গন্ধ আর সাদা হলুদের মিশেলে বর্ষার দিন যেন কদম ছাড়া কল্পনাই করা যায় না! এ আবেগঘন স্মৃতি আর সৌন্দর্য মাথায় রেখেই কদমফুল বেছে নেওয়া হয়েছে এবারের মূল থিম হিসেবে।
এই সংগ্রহে থাকছে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া বা কামিজ, ব্লাউজ এবং ছোটদের পোশাক। আরামদায়ক ও হালকা কটন কাপড়ে ডিজিটাল প্রিন্ট ও স্ক্রিন প্রিন্টের মিশেলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কদম ফুলের নকশা। সঙ্গে সবুজ পাতা এবং বৃষ্টির নীল মিলে ফুটে উঠেছে বর্ষার সৌন্দর্য। রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস বলেন, ‘বর্ষা এলেই যেসব ফুলের কথা প্রথম মনে পড়ে, তার মধ্যে কদম অন্যতম। বৃষ্টির ফোঁটার মতোই কদম ফুটে ওঠে প্রকৃতির আঁচলে— নিভৃতে, কোমলতায়, যেন জলভেজা দুপুরের শান্ত প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও কদম এসেছে- ‘কে গেলি বল কদম তলায়?’Ñ এই লাইনেই যেন ফুটে ওঠে বর্ষার অন্তরাল রোমান্স। তবে কদম শুধু রূপ নয়, বরং এক ঋতুর স্মারক। এটা বলে দেয়, বর্ষা এসেছে। কদম ফুল, যা বাংলার বর্ষার প্রতীক, ভালোবাসার এক মৌন প্রতিচ্ছবি- সে-ই ফুলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে রঙ বাংলাদেশের পোশাকের গল্প। বর্ষা এক রোমান্টিক, কখনও-বা বিষণ্ন, আবার কখনও উজ্জ্বল আনন্দের যেমন প্রতীক, তেমনি রঙ বাংলাদেশের নতুন পোশাক লাইনেও বর্ষার সেই বহুমুখী রূপ প্রতিফলিত হবে।’
বরাবরের মতোই এ বছরও দেশীয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড ‘লা রিভ’ নিয়ে এসেছে তাদের ‘দি রেইনি ডে কিউরেশন’। বর্ষায় পরার উপযোগী রঙ, বিশেষ ছাঁট ও দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী করে এই পোশাকগুলো তৈরি করা হয়েছে। লা রিভ রেইনি ডে কিউরেশনে মূলত হালকা ও নরম ধরনের কাপড়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফেব্রিকের মাঝে রয়েছে জর্জেট, হালকা ধরনের ক্রেপ, ভিসকস, কটন ও মিক্সড সুতায় তৈরি পোশাক। এ ধরনের পোশাকগুলো পরিষ্কার করা সহজ এবং সহজে দাগ বসে না, এ ছাড়াও হুটহাট বৃষ্টি থেমে ভ্যাপসা গরমেও বেশ আরাম বোধ হয়। রঙ হিসেবে নীল ও আকাশির বিভিন্ন শেডের সঙ্গে সবুজ, অল্প কিছু লাল ও কমলা, মেরুন ও কালো ধরনের কিছু গাঢ় রঙ বেছে নেওয়া হয়েছে বর্ষার চিরাচরিত রূপ অনুযায়ী।
টপস, কামিজ ও টিউনিকের ক্ষেত্রে লা রিভ বেছে নিয়েছে একটু খাটো ডিজাইন। বৃষ্টির দিনে লম্বা পোশাকে জল-কাদার দাগ পড়ার সম্ভাবনা বেশি বলেই এ রকম মাঝারি থেকে একটু খাটো ধরনের পোশাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে শাড়ি ও পাঞ্জাবি, যাতে রঙ হিসেবে নীল, ধূসর ও সাদার সঙ্গে রয়েছে মেরুন, হলুদ বা গোলাপিও। পোশাকগুলো এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে হঠাৎ গরম অথবা বৃষ্টি, দুই রকমের আবহাওয়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যে পরা যায়। বৃষ্টির দিনে কলেজ, ভার্সিটি, অফিস, ঘোরাঘুরি অথবা পার্টি, যেকোনো উপলক্ষেই ব্যবহার করা যাবে লা রিভের এ পোশাকগুলো।
এসব ব্র্যান্ড ছাড়াও নগরের বড় বড় শপিং মল ও মার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। ঢাকার নিউ মার্কেট, নূরজাহান মার্কেট, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স ইত্যাদি মার্কেটে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পোশাক, যা থেকে আপনি বেছে নিতে পারেন আপনার মনের মতো ফ্যাশন ও স্টাইলের পোশাকটি।
সাজ ও অনুষঙ্গ
বৃষ্টি পড়ায় সাজগোজ কি থেমে থাকবে? একদমই না। আবহাওয়ার সঙ্গে মিলিয়েই হালকা স্নিগ্ধ সাজ বেশ ভালোভাবে মানিয়ে যায় বর্ষার সঙ্গে। বৃষ্টিতে ভিজে ভারী মেকআপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পানিতে মিশে গিয়ে জামাকাপড়ে লেগে যেতে পারে। তাই হালকা মেকআপ করুন এবং অবশ্যই ভালো ব্র্যান্ডের ওয়াটার প্রুফ মেকআপ প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন। বর্ষার নীলের সঙ্গে মিলিয়ে চোখে ব্যবহার করতে পারেন নীল রঙের কাজল ও আইলাইনার।
গয়নাগাটির দিকে এ সময় দিতে হবে আলাদা নজর। বেশিরভাগ ধাতব গয়নাই বর্ষার উপযোগী নয়। বৃষ্টিতে ভিজে রঙ চলে যাওয়া অথবা জং ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বর্ষায় ব্যবহার করতে পারেন ওয়াটারপ্রুফ গয়না। রেজিন, ফাইবার, কাপড় ও প্লাস্টিক বা কাচ পুঁতির গয়না পানিতে ভিজেও নষ্ট হয় না, তাই এ ধরনের গয়নাগুলোকে রাখতে পারেন পছন্দের তালিকায়। প্লাস্টিক ও ফাইবারের তৈরি শাখা, পলাচুড়ি ও পলা আঙ্টির এখন ফ্যাশনে খুব কদর। এগুলোও পানিতে নষ্ট হয় না, তাই মন ভরে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে এগুলো হতে পারে আপনার সঙ্গী। আর বাঙালি নারীর সব সময়ের প্রিয় কাচের চুড়ি তো আছেই! পেয়ে যাবেন সাধারণ কসমেটিক্সের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মলেও।
এ ছাড়াও বর্ষা মানেই ব্যাগে অতিরিক্ত পলিথিন, ছাতা অথবা রেইনকোট। বৃষ্টি উপলক্ষে রঙ-বেরঙের ছাতা এবং রেইনকোট প্রতিবছরই সবার নজর কাড়ে। কাপড়ের কালো ও গাঢ় রঙের ছাতাগুলোই বেশি দেখা গেলেও ফ্যাশন সচেতন অনেকেই বৃষ্টিতে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ছাতাও ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। ৪০০-৫০০ থেকে শুরু করে ডিজাইন ও মানের ছাতা পাওয়া যায়। অনেকে আবার ছাতা বহন করতে চান না, তাই রঙ-বেরঙের রেইনকোট বা বর্ষাতির দিকেই তাদের আগ্রহ। ৩০০-৪০০ থেকে শুরু করে ১২০০-১৫০০ এর মধ্যে পাওয়া যায় রঙ-বেরঙের বিভিন্ন মানের বর্ষাতি।
বর্ষার আরেকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো একটি ভালো ব্যাগ। বৃষ্টির দিনে বেছে নিতে হবে এমন ব্যাগ, যেটি ওয়াটারপ্রুফ, অথবা ভিতরের লেয়ারটি ওয়াটারপ্রুফ।
দেশীয় অনেক ফ্যাশন হাউস কাজ করছে উন্নত মানের চামড়ার ব্যাগ ও বিভিন্ন চামড়া জাত পণ্য নিয়ে। এ ধরনের চামড়ার ব্যাগগুলো ওয়াটারপ্রুফ, এ ছাড়াও প্রতিটি ব্যাগের ওপরে বিভিন্ন ধরনের হাতে আঁকা ছবি ব্যাগগুলোকে করে তুলেছে আরও অনন্য। তবে যে ধরনের ব্যাগই হোক, ভেজার পরে ঠিকভাবে শুকিয়ে না নিলে অথবা যত্ন না নিলে নষ্ট হবেই, তাই ভিজে যাওয়ার পর ব্যবহারের ব্যাগটি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে ফেলুন। এরপর ভালোভাবে মুছে নিয়ে বাতাসে শুকিয়ে ফেলুন।
ভোলা যাবে না জুতার কথাও। বৃষ্টির দিনে রাস্তায় প্রচণ্ড জলকাদা হয়ে থাকে, তাই শৌখিন নকশা করা জুতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বর্ষার আদর্শ হচ্ছে ফ্লিপ ফ্লপ স্যান্ডেল, যাকে আমরা দুই ফিতা জুতাও বলে থাকি। রাবার, প্লাস্টিক অথবা স্পঞ্জের তৈরি এই ফ্লিপ ফ্লপ স্যান্ডেল পরতে যেমন আরামদায়ক, তেমন পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়ারও সম্ভাবনা কম। হিল পরতে চাইলে অল্প উচ্চতার প্লাটফর্ম হিল বেছে নিন। এ ছাড়াও রয়েছে ক্রকস, দেখতে হাফ শু-এর মতো এই জুতায় ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, যার ফলে পানি জমে না। তবে পরার জন্য এমন জুতা বেছে নেবেন যেটা অ্যান্টি স্লিপ হবে, সহজে পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
বাড়তি কিছু সচেতনতা