আয়েশা সিদ্দিকা
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ১৩:৫৭ পিএম
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫ ১৪:১৬ পিএম
রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় পুরুষের অস্বস্তিকর চাহনি, ভিড় বাসে আচমকা শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে অযাচিত স্পর্শ কিংবা ফেসবুকে অশালীন মন্তব্যÑ আমাদের চারপাশের পরিচিত যেকোনো নারী জীবনে একবার হলেও এসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। তাই ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণ শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত।
প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে ইভটিজিংয়ের অসংখ্য ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে। কেবল একটি গল্প নয়, এটি প্রতিদিনের বাংলাদেশ, যেখানে হাজারো মেয়ে প্রতিদিন রাস্তায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহনে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইভটিজিং’ নামক এক নীরব সহিংসতার শিকার। তাদের হাহাকার কেবলমাত্র একটি সংখ্যায় আটকে থাকে।
২০২৫ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নারী নির্যাতন ও সহিংসতা বিষয়ক প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি এবং ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান নারী সহিংসতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২২ জন নারী এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১৪টি, ধর্ষণের পর হত্যা দুটি, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা একটি। এ ছাড়া পারিবারিক সহিংসতায় ৪৩টি, নারীর প্রতি অন্যান্য সহিংসতায় ৬৮টি এবং অ্যাসিড নিক্ষেপের দুটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারী ও কন্যা নির্যাতন বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ৭৪ জন কন্যা এবং ১২৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এর মাঝে ৩০ জন কন্যাসহ ৪৪ জন ধর্ষণের শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। ২০১৫ সালে ৭৩ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হলেও ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার। আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৪ শতাংশ নারী ইভটিজিং বা জনসমক্ষে যৌন হয়রানির শিকার।
নারীরা প্রতিনিয়ত স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, কর্মস্থল, বাজারসহ নানা জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। জরিপে জানা যায়, প্রধানত ১০-১৮ বছর বয়সি ৯১.৩ শতাংশ ছাত্রী বা কিশোরী ইভটিজিংয়ের শিকার। এই ইভটিজার হতে পারে তাদের সহপাঠী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কেউ, সহকর্মী, এলাকার কোনো বখাটে বা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ। ইউএনএফপিএ পরিচালিত এক পরিসংখ্যান মতে, এই ইভটিজারদের ৩৪.৬ শতাংশ বেকার যুবক, ৪৮.৯ শতাংশ শ্রমজীবী বা ব্যবসায়ী এবং বাকিরা শিক্ষার্থী ও মধ্যবয়সি পুরুষ।
ধনী-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণির নারীরাই ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন, ভিন্ন বাস্তবতায়, ভিন্ন পরিসংখ্যানে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে এর দৃশ্যমানতা বেশি কারণ তাদের অধিকাংশের সামাজিক প্রভাব নেই, তাই এসব ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পেতে অপারগ। উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়ার হার তুলনামূলক কম।
১৭-১৮ এপ্রিল, ২০২৫। রাজশাহীর তালাইমারীতে ৪৫ বছর বয়সি আকরাম হোসেন স্বীয় মেয়ের ইভটিজিং প্রতিরোধে প্রতিবাদ করলে স্থানীয় বখাটেরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২০২৪ সালের ১৫ মার্চ রাতে কুমিল্লার নিজ বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা। আত্মহত্যার আগে তিনি সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকি আম্মান ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ওই দুই ব্যক্তি নানাভাবে তাকে যৌন হয়রানি ও মানসিক চাপ প্রদান করে; যা শেষমেশ গিয়ে আত্মহত্যায় পৌঁছয়। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা ইভটিজিংয়ের পরিধি এবং মাত্রা একটি ভিন্নরূপ ধারণ করেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিভিশন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া ফেসবুকে এক যুবকের অবমাননাকর মন্তব্যের শিকার হন। অভিনেত্রী যুবকের পরিচয় প্রকাশ করলে জানা যায়, সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। পরে প্রতিষ্ঠানটি ঘটনার তদন্ত করে ওই যুবককে বহিষ্কার করে।
বাংলাদেশে ইভটিজিং সম্পর্কিত আইন
বাংলাদেশের কোনো আইনেই ‘ইভটিজিং’ শব্দটির সরাসরি ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। এই শব্দটির মাধ্যমে নারীদের প্রতি রাস্তাঘাট, গণপরিবহন বা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কোনো জায়গায় বাজে মন্তব্য, যৌন হয়রানি বা অপমানজনক আচরণকে বোঝানো হয়। এ ধরনের কাজগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ইভটিজিং সম্পর্কিত ধারা
১. বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ ধারা ৫০৯
‘কোনো নারীকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শব্দ, অঙ্গভঙ্গি বা কাজ করা।’
এর শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। অশ্লীল কথা বলা, বাজে ইঙ্গিত করা, শিস দেওয়া, রাস্তায় পিছু নেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে এ ধারা প্রয়োগ করা হয়।
২. ধারা ৩৫৪Ñ নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে বলপ্রয়োগ বা হামলা
শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়। যদি ইভটিজিংয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক স্পর্শ বা বলপ্রয়োগ থাকে, তবে এই ধারা প্রযোজ্য হয়।
৩. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
যদিও এই আইন মূলত ধর্ষণ, অপহরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ ইত্যাদির মতো গুরুতর অপরাধের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে যদি ইভটিজিং সহিংস রূপ ধারণ করে, তাহলে এটি এই আইনের আওতায় আসতে পারে। ১০ নম্বর ধারায় যৌননিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।
৪. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল বার্তা পাঠানো, অনুমতি ব্যতীত ছবি প্রকাশ করা এবং হুমকি প্রদান করা হলে এই আইনগুলো প্রযোজ্য। শাস্তিস্বরূপ অপরাধভেদে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
ক্যাম্পেইন
ইভটিজিং প্রতিরোধে কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশে ইভটিজিং প্রতিরোধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতা ক্যাম্পেইনের নাম ও বিবরণ নিচে দেওয়া হলোÑ
১. ‘ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস’ (১৩ জুন)
২০১০ সালে বেশ কয়েকজন কিশোরী ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার এই দিবস ঘোষণা করে।
২. BRAC-‘MEJNIN’ প্রকল্প (Making Education Jovial, Nourishing and Inclusive for the Next Generation)
বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি, যৌন হয়রানি নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা ইত্যাদি জেলায় সচেতনতামূলক কর্মশালা ও ক্লাস নেওয়া হয়েছে।
৩. বাংলাদেশ কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম
বাংলাদেশ পুলিশ এই কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে ইভটিজিং রোধে জনসচেতনতা তৈরি, স্কুল-কলেজ এলাকায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং অভিভাবক-শিক্ষক সম্মেলনের আয়োজন করে। এ ছাড়াও স্কুল-কলেজ এলাকায় মাইকিং ও প্রচার, ‘হেল্প ডেস্ক ফর উইমেন’ চালু, ‘বন্ধু পুলিশ’ নামেও কিছু জায়গায় বিশেষ সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
৪. NaripokkhoÑ ‘Breaking the Silence’ ক্যাম্পেইন
নারীপক্ষ ও সহযোগীদের উদ্যোগে ‘Break the Silence, Eliminate the Violence : 16 Days of Activism’ নামে ১৬ দিনব্যাপী ইভটিজিং ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধমূলক প্রচারণা চালানো হয়। এর কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রাম ও শহর পর্যায়ে যৌন হয়রানি ও ইভটিজিং নিয়ে স্ট্রিট থিয়েটার, ওয়ার্কশপ, স্কুল ক্যাম্পেইন।
৫. UNFPA ও Ain o Salish Kendra (ASK)-এর যৌথ উদ্যোগ
বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রতিরোধে বিভিন্ন উপজেলায় স্কুলভিত্তিক প্রচারণা। প্রশিক্ষণ, ডকুমেন্টারি, সচেতনতামূলক পোস্টারের মাধ্যমে এর প্রচারণা চালানো হয়।
৬.HELP অ্যাপ
Switch Foundation ও BJC মিলে ২০২৫ সালে এই অ্যাপ চালু করে। নারীরা জরুরি অবস্থায় এর মাধ্যমে সহায়তা চাইতে পারেন।
এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেক তরুণ-তরুণী ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, ফেসবুকে পেজ ও আন্দোলনের মাধ্যমে। যেমনÑ ‘Speak Up’, ‘No More Silence’, ‘Break the Cycle’Ñ তরুণরা নিজেরাই তৈরি করেছেন ভিডিও, পোস্টার ও সচেতনতামূলক পোস্ট।
তবে এসব উদ্যোগ বেশিরভাগ সময় অস্থায়ী এবং শহরকেন্দ্রিক। তাই ইভটিজিং প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত, দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
প্রতিরোধে করণীয়
ইভটিজিং প্রতিরোধে কেবল আইন নয়, প্রয়োজন শিক্ষা, প্রযুক্তি, সামাজিক দায়িত্ব ও সচেতনতার সমন্বিত প্রয়োগ।
১. আইনের কঠোর বাস্তবায়ন : দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, মোবাইল কোর্ট এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগী মেয়েরা যেন নিরাপদে অভিযোগ করতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
২. শিক্ষা কারিকুলামে লিঙ্গসমতা ও নৈতিক শিক্ষা : স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও নৈতিকতা ভিত্তিক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এর ফলে শিশুরা বাল্যকাল থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার শিক্ষা পাবে।
৩. প্রযুক্তির ব্যবহার : HELP অ্যাপ বা জরুরি হেল্পলাইন (৯৯৯, ১০৯) সম্পর্কে স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের জানানো উচিত। সিসিটিভি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্থার অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৪. সাহসী সমাজ ও পরিবার : পরিবার থেকেই একটি শিশুর মূল্যবোধ গঠন হতে শুরু করে। তাই পরিবারের মধ্যেই সন্তানদের মাঝে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও সততার চর্চা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সমাজের সচেতন নাগরিকদের প্রতিবাদ জানাতে উৎসাহিত করতে হবে। ভুক্তভোগীদের দোষারোপ না করে পাশে দাঁড়ানো এবং অভিযোগ জানাতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।
৫. পুরুষদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা
শুধু নারীরাই নয়, সামাজিক এই ব্যাধি নিরাময়ে পুরুষদেরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে হবে। ‘He For She’-এর মতো ক্যাম্পেইনের প্রসার দরকার, যেখানে তরুণরা সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়।
৬. স্কুল-কলেজে সুরক্ষা ব্যবস্থা
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেলফ-হেল্প গ্রুপ বা কমপ্লেইন সেল গঠন করা প্রয়োজন। নারী পুলিশের তদারকি ও নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন বিশেষ করে ছুটির সময়।
৭. মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা : ইভটিজিং সংক্রান্ত ঘটনা প্রচারে দায়িত্বশীল ভাষা ব্যবহার এবং নারীকে যৌনায়িতভাবে উপস্থাপন না করা।
লেখিকা : লিড, সিভিল সার্জেন্ট কোয়ালিশন, ইয়ুথ পলিসি ফোরাম