× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আজও অনন্য পোড়াবাড়ির চমচম

অরণ্য ইমতিয়াজ

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ১৩:৫৪ পিএম

আজও অনন্য পোড়াবাড়ির চমচম

‘পোড়াবাড়ির চমচম’ নামটি শুনলেই জিভে পানি এসে যায় এর অতুলনীয় স্বাদের কারণে। পোড়া ইটের মতো রঙের চমচমের স্বাদের আসল জায়গাটি হচ্ছে ভেতরের গোলাপি আভাযুক্ত মৌচাকের মতো ফাঁপা নরম অংশ। দক্ষ কারিগররা দিন দিন এই বিশেষ খাবারটাকে লোভনীয় করে তুলেছেন, করেছেন ব্যাপক জনপ্রিয়। এর সুনাম শুধু টাঙ্গাইল বা পোড়াবাড়িতে নয়, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বাইরেও এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। 

দেশের মিষ্টির রাজা বলে খ্যাত ‘পোড়াবাড়ির চমচম’ টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পোড়াবাড়িতে প্রস্তুত হয়। এদেশের মানুষের রসনাতৃপ্তির প্রিয় মিষ্টি এটি। শুধু বাঙালিরই নয়, ভারতবর্ষসহ অনেক দেশের মানুষের প্রিয় এ মিষ্টির ঐতিহ্য প্রায় ২০০ বছরের। বাঙালি ললনার প্রিয় পোশাক টাঙ্গাইল শাড়ির যেমন খ্যাতি, তেমনিই খ্যাতি এই চমচমেরও। ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন জমকালো অনুষ্ঠানেও পোড়াবাড়ির চমচম না থাকলে আতিথেয়তায় যেন ঘাটতি থেকে যায়। বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে পোড়াবাড়ির চমচম পরিবেশন করা হলে অনুষ্ঠানের মান বিশেষ মাত্রা পায়। 

চমচমের আদি বাড়ি

টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত একটি গ্রাম পোড়াবাড়ি। এই গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরেক গ্রাম চারাবাড়ি। এই এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী। এই নদীর তীরে চারাবাড়িতে একসময় স্টিমার ঘাট ছিল। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্টিমার, লঞ্চসহ বড় বড় নৌকা এসে ভিড়ত। ব্রিটিশ শাসনামলে এই পথ দিয়ে আসাম-কলকাতার স্টিমারও চলাচল করত। পোড়াবাড়ি থেকে কারিগররা গিয়ে প্রথম দিকে সেই ঘাটেই তৈরি করতেন চমচম। পরে নদীতে চর পড়তে পড়তে একসময় ঘাট বন্ধ হয়ে যায়। তখন পোড়াবাড়িতেই তৈরি হতে থাকে এ মিষ্টি। বর্তমানে পোড়াবাড়িতে কিছু পরিবার চমচম তৈরি করে। বেশিরভাগ চমচম এখন টাঙ্গাইল শহরের দোকানগুলোতেই তৈরি হয়। 

চমচমের আসল রহস্য

পোড়াবাড়ির বিখ্যাত চমচম তৈরির দক্ষ কারিগরের পক্ষেও টাঙ্গাইলের বাইরে গিয়ে এমন সুস্বাদু এবং নরম চমচম তৈরি সম্ভব নয়। এর পেছনের রহস্য মূলত পোড়াবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদীর পানি। এই নদীর স্বচ্ছ পানি এবং নদীর চরাঞ্চলের টাটকা ঘাস খেয়ে গাভির ঘন খাঁটি দুধ থেকে তৈরি হতো চমচম। বিদেশি জাতের গাভির দুধের মিষ্টি ততটা সুস্বাদু হয় না। চমচম তৈরির উপকরণ বলতে দুধের ছানা আর চিনি। ছানার ময়ান বানাতে আর চিনির শিরা তৈরিতে লাগে পানি। চমচমের প্রবীণ কারিগররা জানান, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদীর পানি ছাড়া একই মানের চমচম তৈরি করা সম্ভব নয়। এখানকার মাটির কারণেই পানির এক অজানা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় বলে এমনটি ঘটে। আর এ কারণেই টাঙ্গাইল ছাড়া বাইরের কোথাও এ মানের চমচম তৈরি হয় না।

টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত পূর্বাকাশ পত্রিকার সম্পাদক খান মোহাম্মদ খালেদ জানান, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কাছ থেকে শোনা গিয়েছিল একটি কাহিনী। তাঁর আবাস ও রাজনীতির কর্মস্থল সন্তোষে এক বৈঠকের আলোচনায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে সন্তোষের জমিদার পরিবারের এক কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল কলকাতায়। সেই অনুষ্ঠানের অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য পোড়াবাড়ির চমচম দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চমচম তৈরির জন্য পোড়াবাড়ি থেকে কয়েকজন দক্ষ কারিগর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। কয়েক দিন চেষ্টার পরও তারা শেষ পর্যন্ত পোড়াবাড়ির মানের চমচম তৈরি করতে ব্যর্থ হন। তার প্রধান কারণই ছিল ধলেশ্বরী নদীর পানি না পাওয়া।

এখন ধলেশ্বরী নদীতে চর পড়ে প্রায় শুকিয়ে গেছে। গাভিকে খাওয়ানো হয় ঘাস ছাড়াও নানা খাবার। সেই পানি আর দুধ এখন পাওয়া যায় না। দুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কোথাও কোথাও ছানার সঙ্গে ময়দা মেশানোর কথাও শোনা যায়। এতে চমচমের স্বাদ আর মান দুটোই কমে যায়। এ চমচম মুখে দিয়ে নরম আর মোলায়েম ভাবটি পাওয়া যায় না। আগের সেই স্বাদ না থাকলেও খ্যাতি ঠিকই রয়েছে। তবে নতুনরা এখনও অন্যরকম মজা পান চমচমের মধ্যে।


চমচমের ইতিহাস

পোড়াবাড়ি এলাকার দেব নারায়ণ গৌড় এবং বাঙালি গৌড় (বাঙালি হালই নামে বেশি পরিচিত) সত্তরের দশকে চমচম বানিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। বাঙালি গৌড়ের কাছ থেকে অনেকেই এই মিষ্টি ব্যবসা শিখেছিলেন। তারা জাদুকরী চমচম তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। পাকিস্তান আমলে বেশ নামডাক হয় তাদের। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষে যে কাগমারী সম্মেলন হয়েছিল, তাতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। 

শ্যামার ঘাট

চারাবাড়িতে ধলেশ্বরী নদীর যে ঘাট ছিল সেটিকে স্থানীয়রা একসময় ‘কোল’ ঘাট বলতেন। কোল ঘাটের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ঘাটের খানিকটা দূরেই ছিল চারাবাড়ির দর্জিপাড়া গ্রাম। ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনের নাম ছিল শ্যামা পাটনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে তিনি ওই ঘাটে খেয়া পারাপার করতেন। পরবর্তীতে শ্যামা পাটনির নামে ওই ঘাটের নাম হয় ‘শ্যামার ঘাট’। এই ঘাটে বেশ কিছু চমচমের দোকান ছিল। সেখানেই তৈরি করা হতো চমচম। স্বাধীনতার ৩-৪ বছর পর থেকে ধলেশ্বরীতে চর পড়তে থাকে। চরের কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একসময় শ্যামার ঘাটে চমচম তৈরিও বন্ধ হয়ে যায়। চমচম তৈরির কারিগররা পেছন দিকে পোড়াবাড়ি চলে আসেন। আর সেখানেই তৈরি করতে থাকেন চমচম।

দুধের বাজার

ব্রিটিশ আমল থেকে পোড়াবাড়ি দুধের বাজার বসে। এখনও রয়েছে সে বাজার। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে এক ঘণ্টা চলে এ বাজার। পোড়াবাড়িসহ আশপাশের এলাকার মানুষ তাদের গাভির দুধ নিয়ে আসেন এখানে। এক ঘণ্টার মধ্যে সব দুধ বিক্রি হয়ে যায়। মঙ্গলবার বসে সাপ্তাহিক হাট। এদিন সাড়ে ১২টার দিকে শুরু হয় দুধের বাজার। স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপর দুধ বিক্রি হতো ২৫ পয়সা সের। এখন বিক্রি হয় গড়ে ৬০, ৭০, ৮০ টাকা কেজি। পাইকাররাই (ঘোষ) এখানকার প্রধান ক্রেতা।

চমচমের দাম

১৯৭২ সালের দিকে পোড়াবাড়িতে চমচম বিক্রি হতো প্রতি সের ২ টাকা। এখন মানভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে চমচম বিক্রি হয়। দামের সঙ্গে মিল রেখে স্বাদও কমবেশি হয়ে থাকে।

পোড়াবাড়ির বর্তমান অবস্থা

ধলেশ্বরী নদী এখন প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া নাব্যতা থাকে না। লঞ্চ, স্টিমার চলাচল তো দূরের কথা ভরা বর্ষায়ও নৌকা চলা ভার। এ অবস্থাসহ নানা কারণে পোড়াবাড়ি তার মিষ্টির ঐতিহ্য হারাতে বসলেও এখন পর্যন্ত কয়েকটি পরিবার টিকে আছে মিষ্টি তৈরির ওপর নির্ভর করে। 

পোড়াবাড়ি ও চারাবাড়ি বাজারে এখন হাতে গোনা কয়েকটি চমচমের দোকান রয়েছে। চমচম তৈরির কারখানা রয়েছে ১৩টি। এই কারখানায় যে পরিমাণ চমচম তৈরি হয় তার প্রায় পুরোটাই রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ হয়ে থাকে। 

টাঙ্গাইল শহরে মিষ্টিপট্টি নামে খ্যাত একটি এলাকা রয়েছে, যেখানে মিষ্টির দোকান আছে প্রায় ২৫টি। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরও ২৫টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কয়েকশ শ্রমিক কাজ করেন মিষ্টি তৈরিতে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা