ক্যালরি ডেফিসিটে খাওয়ার সহজ পদ্ধতি ও ব্যায়ামের কিছু নিয়ম
ক্যালরি ডেফিসিটে খাওয়ার কৌশল
ক্যালরি ডেফিসিট মানে আপনি দৈনিক যত ক্যালরি গ্রহণ করছেন, তার চেয়ে বেশি ক্যালরি খরচ করছেন। এর ফলে শরীর জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে শক্তি তৈরি করে এবং ওজন কমতে থাকে। তবে এটি যেন অতিরিক্ত ডেফিসিট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
প্রথমে নিজের দৈনিক ক্যালরি চাহিদা (বিএমআর ও অ্যাক্টিভিটি লেভেল অনুযায়ী) নির্ধারণ করে তাতে ৩৫০-৫০০ ক্যালরি মাইনাস ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার দৈনিক ক্যালরি চাহিদা হয় ২০০০, তাহলে ১৫০০-১৬৫০ ক্যালরি খেলে একটি স্বাস্থ্যকর ডেফিসিট তৈরি হয়।
খাবারে প্রাধান্য
প্রোটিন : ডিম, মাছ, মুরগি, ডাল, টফু, সয়াবিন এগুলো পেশি ধরে রাখতে সাহায্য করে
কমপ্লেক্স কার্ব : রোল্ড ওটস, লাল চাল, রাগি আটা, কিনোয়া ধীরে হজম হয় ও শক্তি দেয়
ফাইবার : শাকসবজি, ফল ইত্যাদি পেটভরা রাখে ও হজমে সহায়তা করে।
ভালো ফ্যাট : অলিভ অয়েল, কোকোনাট অয়েল, বাদাম, চিয়া সিড, পাম্পকিনসহ বিভিন্ন ধরনের সিডস হরমোন ব্যালান্স ঠিক রাখে
চিনি, সফট ড্রিংক, ভাজাপোড়া, প্রসেসড খাবার একদম বাদ দিতে হবে। দিনে অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করার পাশাপাশি খাবার সময়মতো খাওয়াও জরুরি। সঙ্গে নিয়মিত ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।
ব্যায়াম : ফিটনেস ধরে রাখার সহায়ক
ক্যালরি ডেফিসিটে খাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শরীর সচল রাখার জন্য ব্যায়াম অপরিহার্য। ৭০ শতাংশ যেমন খাদ্য নিয়ন্ত্রণ তেমনি ৩০ শতাংশ ব্যায়াম অপরিহার্য। তবে শরীরের ব্যথা বা আর্থ্রাইটিস থাকলে সব ব্যায়াম করা নিরাপদ নয়। তাই এমন ব্যায়াম বেছে নিতে হবে, যা জয়েন্টের ওপর চাপ না দিয়ে পেশি ও ফিটনেস বাড়াতে সাহায্য করে।
যেসব ব্যায়াম উপযোগী
চেয়ার স্কোয়াট : চেয়ারের সাহায্যে ধীরে বসা-ওঠা, হাঁটুকে চাপ না দিয়ে পা শক্ত করে।
লেগ রেইজ : ইয়োগা ম্যাট বা শক্ত বিছানায় শুয়ে এক পা করে উঠিয়ে নামানো, যা জয়েন্টে চাপ না দিয়ে পেশিকে সক্রিয় রাখে।
ওয়াল পুশ আপ : যেখানে দেয়ালে ঠেলে বুক, আর্মস ও কাঁধের পেশি সক্রিয় করা হয়। এটি হাঁটু ও কবজির জয়েন্টের ওপর চাপ ফেলে না।
স্টেশনারি সাইক্লিং : ধীরে ও হালকা গতি বজায় রেখে সাইক্লিং হাঁটুর জন্য নিরাপদ।
সাঁতার : পানিতে শরীরের ওজন কম থাকে, ফলে হাঁটুতে চাপ পড়ে না।
যোগব্যায়ামও সবার সঙ্গে আর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্যও সহায়ক হতে পারে। জয়েন্ট ফ্রেন্ডলি কিছু যোগব্যায়াম : বোঝার সুবিধার্থে ইংরেজি নামসহ কিছু যোগব্যায়ামের নাম দেওয়া হলো। নিয়মিত ব্যায়ামের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি যোগব্যায়াম/স্ট্রেচিং ১৫-২০ সেকেন্ড করে করলে উপকার পাবেন।
Tree Pose (ট্রি পোজ), Cobra Pose (কোবরা পোজ), Bridge Pose (ব্রিজ পোজ), Cat-Cow Stretch (ক্যাট-কাউ স্ট্রেচ), Childs Pose (চাইল্ডস পোজ)
আরও কিছু ব্যায়াম
ব্যায়ামের নিয়মকানুন নিয়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, সব সময় সময় সুযোগ বুঝে ব্যায়াম করে ওঠা কিছুটা কঠিন। বিশেষ করে এই ব্যস্ত সময়ে আলাদাভাবে ব্যায়ামের জন্য ঘণ্টাব্যাপী সময় বের করতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হয় কঠিন পরিস্থিতির। তবু শরীর বলে কথা! কিছু ওয়ার্কআউট একদমই না করলে শরীরও দিন দিন খারাপ হতে থাকবে। সহজ কয়েকটি ব্যায়াম সম্পর্কে চলুন জেনে নেওয়া যাক, যা আপনি করতে পারবেন যেকোনো সময়।
স্কোয়াট : এটা মূলত ওঠাবসা। এই ব্যায়ামে সবচেয়ে বেশি উপকার হয় মাংসপেশিতে। বেশ ক্যালরি খরচ হয় বলে শরীরও সুগঠিত থাকে। যদি মাংসপেশির প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চান, তাহলে হাতে ডাম্বেল বা ভারী কিছু রাখতে পারেন।
স্কিপিং : শরীর সুস্থ রাখার পাশাপাশি মুহূর্তেই ছোটবেলায় ফিরে যাবেন যদি দড়ি লাফ বা স্কিপিং-কে প্রতিদিনের সঙ্গী করে তোলেন। যেকোনো জায়গায় এই অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারবেন। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় ব্যাগেও রাখতে পারবেন। এই ব্যায়ামে মাংসপেশি উন্নত তো হবেই, সঙ্গে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ উপকৃত হবে। দিনে ১-২ বেলা ১০ বার করে লাফ দিতে পারেন। অল্প সময়েই বেশখানিকটা ব্যায়াম করা হয়ে যাবে। তবে যারা আর্থ্রাইটিস, ইনজুরি বা পিসিওএসে ভুগছেন তারা স্কিপিং স্কিপ করবেন। নইলে শরীরে জটিলতা বাড়তে পারে।
দৌড়ানো : যদি হতাশা কাটাতে না পারেন, মন সব সময় খারাপ থাকে, তাহলে জোরে জোরে হাঁটা বা দৌড়ানোর মতো ব্যায়ামটি করতে পারেন। এতে হৃদযন্ত্রের উন্নতিও হয় বেশ। চেষ্টা করবেন টানা ২০-৩০ মিনিট হাঁটার। যদি একবারে না পারেন তাহলে সকালে ও বিকালে সময় ভাগ করে নিয়ে ২০ মিনিট করে হাঁটবেন। শুরুতেই জোরে না দৌড়িয়ে প্রথমে ব্রিস্ক ওয়াক/জগিং দিয়ে শুরু করলে ধীরে ধীরে গতি বাড়ানো যেতে পারে।
জুম্বা : সংগীতের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জুম্বা করা হয়। তবে যাদের বয়স কম ও ফিটনেস ভালো, তাদের জন্য জুম্বা করাটা বেশি ভালো। শরীর ও মন ভালো রাখতে জুম্বা খুবই কার্যকরী। বিশেষ করে বয়স ১৪ বছরের নিচে হলে এরোবিক্স ড্যান্স/ জুম্বা বেশি উপযোগী। এভাবে ছোট থেকে অ্যাকটিভ থাকলে ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে গেলে স্ট্রেংথ ট্রেনিং এ আগ্রহী হয়ে ওঠা সম্ভব। এতে বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়।
ক্রাঞ্চেস : বিছানায় বসে সহজেই করতে পারবেন এই ব্যায়াম। বিছানায় শুয়ে হাঁটুকে ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়ে হাত দুটি মাথার নিচে রাখুন। মাথা ও ঘাড় সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ এই ভঙ্গিতে থাকুন। পেটের বাড়তি মেদ ঝরাতে এবং শারীরিকভাবে চাঙ্গা থাকতে এই ব্যায়ামটি উপকারী।
লাঞ্জেস : লাঞ্জেস খুব ভালো স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ। থাই ও হ্যামস্ট্রিং, দুই-ই টোনড হবে এতে। একটি পা সামনে এগিয়ে হাঁটু ভাঁজ করতে হবে। আর একটা পা পেছনে দিয়ে স্ট্রেচ করে বসার মতো করে শরীরটা ওপর-নিচ করতে হবে। কাঁধ যেন সোজা থাকে। এটি প্রথমে ১০টি করে প্রতি পায়ে তিনবার যথেষ্ট।
ব্রিজ : প্রথমে মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাঁটু ভাঁজ করে পা দুটো নিতম্বের কাছে রাখুন। এবার ধীরে ধীরে মাটি থেকে কোমর তুলে ধরে দুই হাত টান টান করে, গোড়ালি স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। এই অবস্থানে ১০ সেকেন্ড থাকুন। ৪ থেকে ৫ বার এভাবে অভ্যাস করুন।
জাম্পিং জ্যাক : জাম্পিং জ্যাক কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই যেকোনো জায়গায় করা যেতে পারে। পা দুটি ফাঁক করে মাথার ওপর হাত তোলা, নামানো এর পদ্ধতি। এটি কার্ডিওভাসকুলার সহনশীলতা উন্নত করতে, পেশি শক্তিশালী করতে এবং ক্যালরি বার্ন করতে সহায়তা করে। এই অনুশীলনটি এক মিনিটের জন্য, তারপর ১৫ সেকেন্ডের জন্য বিশ্রাম নিয়ে আবার দুটি, মোট তিনটি সেটে করতে পারেন।
সচল থাকা : বেশিরভাগ সময় সচল থাকার চেষ্টা করুন। এক জায়গায় অনেকক্ষণ বসে না থেকে কিছু সময় পরপর উঠে দাঁড়ান, হাঁটুন, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করুন, বডি স্ট্রেচ করুন।
ফিটনেস ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সচেতন খাওয়া এবং নিজের শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যায়ামের অভ্যাস। ক্যালরি ডেফিসিটে খাওয়া মানে না খেয়ে থাকা নয়, বরং কম ক্যালরিতে পুষ্টিকর ও পরিমিত খাবার খাওয়া। আর হাঁটুব্যথা বা আর্থ্রাইটিস থাকলেও ব্যায়াম একেবারে বাদ দেওয়া উচিত নয়। বরং সঠিক ব্যায়াম পদ্ধতি বেছে নিলে ব্যথা কমে, ওজন কমে এবং ফিটনেসও দীর্ঘমেয়াদে বজায় থাকে। ছোট ছোট পরিবর্তনই গড়ে তোলে বড় ফলাফল এই বিশ্বাসেই শুরু হোক ফিট থাকার পথচলা।
লেখক : সার্টিফায়েড আইএসএসএ ফিটনেস কোচ অ্যান্ড পারসোনাল ট্রেইনার (ইউএস ভেরিফায়েড)
মডেল : তৌফিক আরা কথা ও শামা মাখিং, ছবি : আবুল কালাম আজাদ