× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষক থেকে কৃষক হওয়ার গল্প

অরণ্য ইমতিয়াজ

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫ ১২:২৮ পিএম

শিক্ষক থেকে কৃষক হওয়ার গল্প

জামাল হোসেন ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। তার চার মেয়ে ও একমাত্র ছেলেসন্তান। তার স্বপ্ন ছিল- একমাত্র ছেলে হবে চাকরিজীবী। তার মতো কৃষক হয়ে সাধারণ জীবনযাপন যেন ছেলেকে করতে না হয়। তাই তিনি কখনও ছেলেকে কৃষিকাজে তার সঙ্গে নিতেন না। ছেলেকে ভর্তি করে দেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। ছেলেও মনোযোগী ছাত্র। প্রাইমারি স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে ভর্তি হন মাধ্যমিক স্কুলে। তার পর কলেজে। ১৯৯৩ সালে মধুপুর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। খুশিতে মন নেচে উঠে জামাল হোসেনের। তার কলিজার টুকরা ছেলে ছানোয়ার হোসেন বিএ পাস করেছে। এবার তার স্বপ্নপূরণের পালা।

বিএ পাসের পর কিছুটা অবসর সময় পান ছানোয়ার হোসেন। এ সময়টা একটু ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা হয়। চলে যান সিলেট। সেখানে গিয়ে এক কলেজে ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের খবর পান। ইন্টারভিউ দেন তিনি। ইন্টারভিউতে পাস করেন এবং বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কলেজে যোগ দেন। ইংরেজি শিক্ষক হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছানোয়ার হোসেনের কর্মজীবন।

কিছুদিন পর তিনি উপলব্ধি করলেন- এ পেশায় তার মন বসতে চাইছে না। কী যেন এক শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরছে। দিন দিন এ শূন্যতা বাড়তে থাকে। লেখাপড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা মন্তব্য তাকে আরও ভাবিয়ে তোলে। কলেজ পাস করেও অনেক শিক্ষার্থীই বেকার থেকে যাচ্ছেন। তিনি ভাবেন, যে লেখাপড়া মানুষকে কর্মক্ষম করতে পারে না, সেটা কেমন লেখাপড়া। এ পেশায় আর থাকা যাবে না। একটা স্বাধীন পেশা বেছে নেওয়া উচিত- যে পেশায় স্বাধীনতার পাশাপাশি সুখ থাকবে, সমৃদ্ধি-শান্তি থাকবে। আর সেটা একমাত্র সম্ভব কৃষিতে। কৃষিকাজে কর্মসংস্থানের অভাব নেই। এই ভাবনা থেকেই ছানোয়ার হোসেন সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকতা ছেড়ে কৃষক হওয়ার। চলে আসেন গ্রামে, যোগ দেন কৃষিকাজে।

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের ছানোয়ার হোসেন এখন একজন আদর্শ কৃষক। কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারসহ বেশকিছু পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। কথা হয় ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি তার জীবনের বাকি গল্পও জানান।

১৯৯৭ সালে গ্রামে এসে বাবার ১০ একর জমিতে প্রচলিত চাষ শুরু করেন। তার ফিরে আসা এবং কৃষিকাজে যোগ দেওয়ায় বাবা খুশি হতে না পারলেও এ কাজে তাকে বাধা দেননি। তবে এলাকার মানুষ তাকে ভর্ৎসনা করেছে। কেউ কেউ বলেছে, ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’। নানা অপবাদ মাথায় নিয়েও তিনি থেমে যাননি। প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যমে এগিয়ে গেছেন। 

ছানোয়ার হোসেন কয়েক বছর আনারস চাষ করতে গিয়ে লক্ষ করলেনÑ আনারস আবাদ নিয়ে নানা প্রপাগান্ডা চলছে। বিষে শেষ হয়ে যাচ্ছে আনারস! তখন তিনি প্রচলিত আবাদ থেকে বের হয়ে আধুনিক কৃষির দিকে ঝুঁকেন। ছানোয়ার হোসেন মনে করেন, যে ফল আমার সন্তানকে খাওয়াতে পারব না, সেটা অন্যের সন্তানের জন্যও প্রস্তুত করব না। ফল সৃষ্টিকর্তার দান। একে নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। এ ভাবনা থেকে তিনি শুরু করলেন বিষমুক্ত আবাদ। তার জমির প্রায় সব ধরনের ফল প্রাকৃতিকভাবে আবাদ করা হচ্ছে। পেঁপে, পেয়ারা, কুল, মাল্টা, ড্রাগন, কলা, আনারসসহ নানা ধরনের আবাদ তিনি করছেন।

নিরাপদ চাষাবাদ 

অধিক মুনাফার আশায় একসময় মধুপুরের আনারসে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এতে আনারস বাইরে থেকে হলুদ ও লালচে রঙ ধারণ করে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ক্ষেতের সব আনারস পাকেও একসঙ্গে। ফলে চাষিরা আনারসগুলো একসঙ্গে বাজারে তুলতে পারেন। আর আকর্ষণীয় রঙ হওয়ায় ক্রেতার চাহিদা বাড়ে। বিক্রি হয়ে যায় সহজে। অন্যদিকে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার না করলে আনারস ভেতরে পাকা থাকলেও বাইরে থেকে সবুজ রঙ দেখায়। কাঁচা ও আকর্ষণীয় মনে না হওয়ায় ক্রেতার চাহিদা কমে যায়। বিক্রিতেও সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে চাষির। সে ক্ষতির আশঙ্কা নিয়েই ২০০০ সালের দিকে তিনি শুরু করেন বিষমুক্ত আনারস চাষ। ছানোয়ার হোসেন বলেন, রাসায়নিক প্রয়োগ করা আনারস খেতে স্বাদ লাগবে না, ঘ্রাণও পাওয়া যাবে না। তবে ভোক্তারা এসব বিবেচনা করেন না। তারা চান চটকদার রঙ। 

রাসায়নিক বা হরমোন না প্রয়োগ করলে বাজার ধরা কষ্ট হলেও তিনি কেন আবাদ করেছেনÑ উত্তরে ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটা একধরনের অপরাধ। আমি সেই অপরাধ করতে চাইনি। খাদ্যে কেমিক্যাল দিয়ে নষ্ট করলে বিবেকের কাছে হেরে যাব। আমি হারতে চাই না। তা ছাড়া নিজের সন্তানকে যেটা খাওয়াতে পারব না, সেটা কেন অন্যের সন্তানকে খাওয়াব?’ 

ক্ষতির আশঙ্কা নিয়ে আনারস আবাদ শুরু করলেও ছানোয়ার হোসেন এখন আশাবাদী। তার বিশ্বাস, ভালো খাদ্যের মূল্যায়ন একসময় নিশ্চয় হবে। তার বিশ্বাসের প্রতিফলনও ঘটতে শুরু করেছে। তিনি ভালো সাড়া পাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে তার আনারস নেওয়ার প্রস্তাব আসছে। 

ছানোয়ার হোসেন অসাধু চক্রের মাধ্যমে আনারসের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে শুরু করেন নিরাপদ আনারস চাষের সংগ্রাম। প্রথম দিকে এককভাবে নিরাপদ আনারস বিপণনে তিনি বিভিন্নভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এর পরও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। নিরাপদ আনারস নিয়ে প্রচারণার কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এককভাবে তিনি আনারসের জোগান দিতে পারছিলেন না। পরে তিনি এলাকার ৫০ জন প্রগতিশীল চাষি নিয়ে গঠন করেন নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড; যার মাধ্যমে নিরাপদ আনারস উৎপাদন করে তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

কী কী চাষ করছেন 

আনারসের পর কৃষক ছানোয়ার হোসেন ২০১৫ সালে মধুপুরে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। এতে তিনি ব্যাপক সফলতা পান। রোগবালাই কম হওয়ার পাশাপাশি চাষ পদ্ধতি সহজ হওয়ায় তিনি ড্রাগন চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার বাগানে তিনি লাল, হলুদ ও সাদাÑ তিন ধরনের প্রায় ৩০০টি ড্রাগন চারা রোপণ করেছেন। ভালো দামে ড্রাগন বিক্রিও করছেন।

নানান ফল-সবজি চাষে ছানোয়ার হোসেনের আগ্রহ বাড়তে থাকে। যখনই তার মনে হয়েছে তখনই কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি শখের বসে কফি চাষ শুরু করেন। রাঙামাটি জেলার রায়খালী থেকে ২০০টি চারা সংগ্রহ করেন। মধুপুরের লাল মাটি ও জলবায়ু কফি চাষের উপযুক্ত হওয়ায় এটি চাষ করে তার সফলতা এসেছে। তার বাগানে বর্তমানে ৫০০ পরিপক্ব কফির গাছ রয়েছে। ছানোয়ার হোসেন তার বাগানে অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা এই দুই ধরনের কফি চাষ করছেন। তবে রোবাস্টা গাছের কফি চাষ করে তিনি ভালো ফলন পেয়েছেন। কফির চারাগুলোয় যখন থোকায় থোকায় ফল ধরে, সে দৃশ্য দেখতে এক কথায় চমৎকার। 

ছানোয়ার হোসেনের চাষাবাদ সাম্রাজ্যের মধ্যে পেয়ারাও রয়েছে। তিনি থাই পেয়ারার চাষ করছেন। ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে পেয়ারার বাগান। সারা বছরই কম-বেশি পেয়ার পাওয়া যায় এ বাগান থেকে। স্থানীয় বাজারে তিনি পেয়ারা বিক্রি করে থাকেন। তবে মধুপুর ছাড়াও টাঙ্গাইলের অন্যান্য অঞ্চলে পেয়ারা সরবরাহ করে থাকেন। 

যেখানে রাসায়নিক প্রয়োগ ছাড়া কলা প্রায় পাওয়া যায় না, সেখানে ছানোয়ার হোসেন নিরাপদ কলা চাষও শুরু করেন। প্রায় ৬০০ শতাংশ জায়গায় রয়েছে তার কলার বাগান। সাগর কলা, শবরি কলা, চাম্পা কলা ও বাংলা কলা তিনি আবাদ করছেন। কলাকে নিরাপদ রাখতে নিয়মিত যত্ন করে থাকেন তিনি। কলার পাশাপাশি তিনি পেঁপের আবাদও করছেন। ৩০০টি গাছ রয়েছে তার পেঁপের বাগানে। তার বাগানে মাল্টাও রয়েছে।

নিরাপদ হওয়ায় ছানোয়ার হোসেনের ফলের চাহিদা রয়েছে। তিনি খুচরা ও পাইকারি দরে এসব বিক্রি করে থাকেন। একসময় সৌখিন চাষি হলেও পরবর্তীতে কৃষিকে জীবনের অংশ হিসেবে বেছে নেন তিনি। কৃষির মধ্যেই খুঁজে পান সুখ, সমৃদ্ধি। তার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ছানোয়ার হোসেন এখন শুধু মধুপুরের পাহাড়িয়া লাল মাটির অঞ্চলের একজন সাধারণ কৃষক নন। তাকে এখন পুরো জেলা চিনে। তিনি এখন আদর্শ কৃষক, অনেকের কাছে প্রেরণার।

সামাজিক কার্যক্রম

ছানোয়ার হোসেন শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে মাটির গন্ধের টানে তিনি ছুটে আসেন গ্রামে, বেছে নেন কৃষিকে। এ পেশায় সফল হলেও শিক্ষার প্রতি তার ভালোবাসাটা থেকেই যায়। সেই ভালোবাসার টান থেকেই তিনি নিজ গ্রাম মহিষমারায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি কলেজ। গ্রামের কৃষকশ্রেণি মানুষ দূরের কলেজে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না। তাদের কথা বিবেচনা করেই ছানোয়ার হোসেনের এ উদ্যোগ। ২০১৪ সালে পাঁচ বিঘা জমি দান করে এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন মহিষমারা কলেজ। কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য কৃষি ও কৃষিকাজে তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে ছানোয়ার হোসেন তার কলেজে ২০১৭ সালে শুরু করেন উৎপাদনমুখী শিক্ষা কার্যক্রম। এখান থেকে শিক্ষার্থীদের বিনোদন ও খেলার ছলে বাড়ির আশপাশে পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত জমিতে নিরাপদ ফল, ফসল ও শাকসবজি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করার চেষ্টা করেন। মহিষমারা কলেজকে সবজি আঙিনা হিসেবে গড়ে তুলেন। শিক্ষার্থীরাও খুব আগ্রহ নিয়ে কৃষিকাজ করছেন।

সম্মাননা

মূলত কৃষিকে ভালোবেসেই এ পেশায় আত্মনিয়োগ করেন ছানোয়ার হোসেন। তিনি কখনও ভাবেননি, তার কৃষিপ্রেম জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হবে। কৃষিকাজে সফলতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৬-এ ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন। এ ছাড়া ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধীকরণ পুরস্কার, চ্যানেল আই কৃষিপদকসহ বেশকিছু পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।

ছানোয়ার হোসেন বলেন, কৃষি ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষ এখন স্বাস্থ্যসচেতন। তারা নিরাপদ খাদ্য পেতে চায়। আর সে চাওয়াকে অনেকটাই পূরণ করতে পারেন একজন সচেতন কৃষক। কৃষিকাজ করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার মানবদেহের জন্য যেমন ক্ষতিকর; তেমনি এটি ফসলের ক্ষেতে মাটির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। দেশে এখন অনেক চাষি জৈব কৃষির দিকে ঝুঁকছেন। তাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও সহযোগিতা দিতে হবে। নিরাপদ খাদ্যকে বাজারজাতকরণে সরকারিসহ সব পর্যায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে কৃষক এগিয়ে যাবে, সেই সঙ্গে বাড়বে দেশের অর্থনৈতিক চাকার গতি। 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা