সাইফুল হক মোল্লা দুলু
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫ ১৩:৫৩ পিএম
মনু মিয়ার পরিচিতি ‘অন্তিম শয্যার কারিগর’ হিসেবে। মনের গহিনের পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পীর মতো তৈরি করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ ঠিকানা কবর। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দূর থেকে দূরান্তরে কারও মৃত্যু সংবাদ কানে আসা মাত্রই খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনাসহ কবর খুঁড়তে বা তৈরি করতে সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান তিনি। এ কাজে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছতে নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন মনু মিয়া। সেই ঘোড়াটিই হয়ে ওঠে তার সহচর- যেটা নিয়ে দিনের আলো হোক কিংবা রাতের অন্ধকার, মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পেলেই টগবগ করে ছুটে যেতেন। হাতে কোদাল, কাঁধে ফাতিলা কাপড়। চোখে নির্ভীক নিষ্ঠা। মানুষের অন্তিম যাত্রায় একান্ত সহযাত্রীর মতো তিনি বাড়িয়ে দেন দুহাত। এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ না নিয়ে এ পর্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর।
কে এই মনু মিয়া
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্ম মনু মিয়ার। বাবা আবদুল হেকিম মিয়া এবং মাতা সারবানুর দুই ছেলে ও মেয়ের মধ্যে মনু মিয়ার অবস্থান তৃতীয়। ছোটবেলায় মনু মিয়া ছিলেন অত্যন্ত ডানপিটে ও দুরন্ত স্বভাবের। সে কারণে বাবা আবদুল হেকিম মিয়া ছেলেকে স্কুলে পাঠালেও লেখাপড়ায় এগোতে পারেননি তিনি। বরং স্কুল কামাই করে বন্ধুদের সঙ্গে হা-ডু-ডু, ডাংগুলি ও ফুটবল নিয়ে মাঠে পড়ে থাকার পাশাপাশি নানা রকম দুষ্টুমিই ছিল তার কাজ। এরপরও ছোট ছেলে হিসেবে বাবা-মায়ের খুব আদরের ছিলেন মনু মিয়া। কৈশোরেই তার আবদার রক্ষা করতে বাবা আবদুল হেকিম মিয়াকে ঘোড়া পর্যন্ত কিনে দিতে হয়েছিল। হাসিখুশি আর হৈ-হল্লায় মেতে থাকা মনু মিয়ার জীবনে হঠাৎ করেই ঘটে ছন্দপতন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে মনু মিয়া তার মাকে হারান। মায়ের কবরে বাবা, বড় ভাই আর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একমুঠো মাটি দিয়ে তাকে শেষ বিদায় জানানোর সময়েও মনু মিয়া বুঝতে পারেননি, তাকে কতটা অসহায় করে চলে গেছেন মা! খুব অল্পদিনেই যখন মায়ের অভাবটা বুঝতে শুরু করলেন, তখন থেকে মনু মিয়াও শামিল হলেন বদলে যাওয়ার মিছিলে। কারও মৃত্যু সংবাদ শুনলেই তার মানসপর্দায় ভেসে উঠত মায়ের কথা। অকৃত্রিম ভালোবাসার সেই মা মাটির ঘরের শেষ বিছানায়, কেমন কাটছে তার দিন? কেমন আছেন মা? মাকে নিয়ে এসব খুব ভাবাত মনু মিয়াকে। ব্যাকুল হৃদয়ে মায়ের কবর জিয়ারতের জন্য ছুটে যেতেন কবরস্থানে। এভাবে যাওয়া-আসা থেকেই স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে মনু মিয়া একদিন কবর খননের কাজে অংশ নেন। প্রথম সে দিনের কথা বলতে গিয়ে মনু মিয়া বলেন, ‘আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার মায়ের শেষ ঠিকানাটা সাজিয়ে দিচ্ছি। এরপর থেকে যখনই সুযোগ পেয়েছি, তখনই তাদের সঙ্গে কবর খননের কাজে অংশ নিয়েছি। এভাবে একসময় এ কাজটার প্রতি আমার অন্যরকমের একটি ভালোলাগা জন্মে গেল। কোনো কারণে যদি একটি কবরে শরিক হতে না পারতাম, মনে হতো কী যেন করা হয়নি।’ একটানা ৩৯ বছর প্রথমে স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে প্রথম প্রথম আত্মীয়স্বজনের কবর খননের কাজে অংশ নিতেন। ক্রমশ দক্ষতা অর্জন করে তিনি হয়ে ওঠেন কবর তৈরির দক্ষ, নিপুণ কারিগর। পরে তার জীবনের বড় আদরের এই কাজটিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। একজন নিখুঁত সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে দুর্গম হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে।
যন্ত্রপাতির বাহার
মনু মিয়ার উপলব্ধিÑ মানুষের অন্তিম শয়ানের কবরটি হতে হবে সুন্দর, নিখুঁত ও সৃষ্টিশীল। কারণ মৃত্যু হচ্ছে জীবনের শেষ ঠিকানা। জন্মের একমাত্র শর্ত হলো মৃত্যু। দুনিয়াদারিতে কত ক্ষমতা, ধন, সম্পদ। অন্তিম শয়ানে কিছুই দেওয়া যায় না। একমাত্র কাফনের কাপড় ছাড়া। তাইতো বিদায়বেলায় কোনো অযত্ন নয়। তাই কবর খুঁড়তে এবং সুন্দর করতে যতসব জিনিসপত্রের দরকার সবই আছে মনু মিয়ার কাছে। কবর খনন করার জন্য নিজের খরচায় তিনি কোদাল, দা, করাত, রামদা, হাতুড়ি, ছোট-বড় খুন্তিসহ সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিয়েছেন।
মনু মিয়ার পদচারণা
ঢাকার বনানী গোরস্তান থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মনু মিয়া কবর খনন করেছেন। বিশেষ করে হাওরের পাঁচটি জেলার ৩৩টি উপজেলার কোনো না কোনো গ্রামে তাকে নিপুণ হাতে কবর তৈরি করতে হয়েছে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি কারও মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন, তিনি সেখানেও কবর খননের কাজে লেগে গেছেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর কবর খোঁড়ার ইচ্ছা নিয়ে তিনি ঢাকায় যান। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পরও তিনি কবর খননের জন্য ঢাকায় চলে যান। কিন্তু তাকে কেউ চেনে না বলে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শুরুতে তার স্ত্রী রহিমা বেগম এ কাজে আপত্তি জানালেও মনু মিয়ার এ কাজের প্রতি আগ্রহ, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দেখে তিনিও একসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্বামীকে উৎসাহিত করেন। রহিমা বেগম তার স্বামীকে যতটা সম্ভব মানসিক সমর্থন দেন।
এখন কেমন আছেন
সম্প্রতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন মনু মিয়া। এরই মধ্যে ঘটে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। বাড়িতে মনু মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। একদিন সকালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের কাটখাল ইউনিয়নের হাসিমপুর এলাকার রাস্তার পাশে খাদে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় ঘোড়াটির নিথর দেহ। ঘোড়াটি যে মনু মিয়ার তা বুঝতে সময় লাগেনি স্থানীয়দের। ঘোড়ার মৃত্যুর খবরে দলে দলে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ একনজর দেখতে আসেন ঘোড়াটিকে। তখনও ঘোড়াটির বুক থেকে রক্ত ঝরছিল আর সেই রক্ত মিশে লাল হয়ে ওঠে জমির পানি। ঘোড়াটিকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার খবর কয়েক দিন পর্যন্ত জানানো হয়নি মনু মিয়াকে। কেননা তিনি নিজেই ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এলাকাবাসী হতবাক হয়ে পড়েন। মনু মিয়ার মতো তার ঘোড়াটিও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল সবার কাছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে কেউ কেউ কান্না আটকে রাখতে পারেননি। কেউ বলেছেন, মনু চাচার ঘোড়াটির মতো এমন প্রাণী আর আসবে না। আঘাত শুধু ঘোড়াটিকে করা হয়নি বরং মনু চাচাকে আঘাত করা হয়েছে। প্রাণীটির মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে এলাকাজুড়ে। আফসোস ও আক্ষেপের পাশাপাশি ঘোড়াটির হত্যাকারীদের শনাক্ত এবং শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মনু মিয়ার এমন সংকটকালে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলার ঘটনাটি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিষয়টি মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। নেটিজেনরা সরব হন বোবা প্রাণীটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বরতার বিরুদ্ধে। নিরীহ প্রাণীটিকে হত্যার ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসীসহ বিবেকবান মানুষ। অনেকেই মনু মিয়াকে ঘোড়া কিনে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। ঘোড়াটিকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাও মনু মিয়ার স্বজন ও গ্রামবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তারা মনু মিয়াকে একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার কিংবা ক্ষতিপূরণ যেটিতেই সবাই সম্মত হয় সেটি করতে চাচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়াকে স্বজনদের মাধ্যমে জানানো হয় বিষয়টি। সবকিছু শুনে মনু মিয়া বিষয়টি বিস্তারিত জানতে ফোন দেন বাড়িতে বাহাদুরের পরিচর্যার দায়িত্ব দিয়ে আসা মহব্বতকে। মহব্বত আমতা আমতা করে খুলে বলেন সবকিছু। কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে যান মনু মিয়া। পথের সাথি ‘বাহাদুর’-এর জন্য চোখ থেকে অশ্রু নামে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন।
মনু মিয়ার প্রতিবেশী কামরুল ইসলাম জানান, একজন সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার সুনাম রয়েছে দুর্গম হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পাশের এলাকায়। এ ছাড়া রাজধানীর বনানী কবরস্থানসহ দেশের নানা প্রান্তে তার সুনাম রয়েছে। শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হননি মনু মিয়া। এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন তিনি, তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ সব লিখে রেখেছেন নিজের ডায়েরিতে। মনু মিয়ার সংকটকালে এভাবে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে মেরে ফেলা হবে, সেটি কেউ ভাবতেও পারেননি।
সম্প্রতি গোরখোদক মনু মিয়ার খবরটি নজরে আসে অভিনেতা খায়রুল বাসারের। তিনি জানতে পারেন, তিন হাজারের বেশি কবর খোঁড়া মনু মিয়ার ঘোড়াটি মেরে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এ খবর পেয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, মনু মিয়াকে আমি ঘোড়া কিনে দিতে চাই। বিনিময়ে আমার কবর খোঁড়া পর্যন্ত আল্লাহ উনাকে বাঁচিয়ে রাখুন। কেউ যদি মনু মিয়ার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, কৃতজ্ঞ থাকব। পরে হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করেন খায়রুল বাসার। এরপর তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘মনু চাচা দোয়া ছাড়া কিছু চান না আপনাদের কাছে। উনি আপনাদের জন্য দোয়া করেনÑ আপনারা ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। চাচা বললেন, ঘোড়ার জন্য তার কষ্ট নেই। কষ্ট নেই, কারা তার ঘোড়াকে হত্যা করেছে তা নিয়েও। চাচা মনে করেন, তার ঘোড়ার সাথে তার যাত্রা এ পর্যন্তই রাখলেন আল্লাহ। ঘোড়াটার কপালে আল্লাহ সময়সীমা এভাবেই নির্ধারণ করেছিলেন। বললেন, ‘সে মারা গেছে তো চোখে দেখি নাই, তাই কষ্ট যেটুকু হবার তাও হচ্ছে না।’
তিনি আরও লেখেন, মানুষের বাইক-সাইকেলের শখ থাকে। আমি যতটা বুঝলাম, উনার শখ ছিল হাতেম তাঈ হওয়াÑ মানুষের প্রয়োজনে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া। উনি উনার সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ কাজটিই করে গেছেন আজীবন। উনি সুস্থ হয়ে আবার উনার শখের কাজে ফিরতে চান দ্রুত। আপনাদের দোয়ায় নিশ্চয়ই আল্লাহ উনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলবেন।