প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ১৭:০৩ পিএম
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন (বিহা)-এর সভাপতি এইচ এম হাকিম আলী।
দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি দুর্বল অবস্থানে পৌঁছেছে—এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন (বিহা)-এর সভাপতি এইচ এম হাকিম আলী। তাঁর মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতায় দেশের পর্যটন শিল্প আজ হুমকির মুখে। অথচ একটু সদিচ্ছা ও প্রণোদনা পেলেই এই খাত হতে পারে অর্থনৈতিক উত্তরণের অন্যতম মাধ্যম।
তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পকে ঘিরে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্পষ্ট নয়। প্রতি বছর বাজেটে পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও, বাস্তব বরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তা প্রতিফলিত করে না। এ বছর বাজেট যেন পর্যটনবান্ধব ও প্রণোদনামূলক হয়, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
বাজেট ও রাজস্ব: বাস্তবতা ও সম্ভাবনা
২০২৩–২৪ অর্থবছরে সরকার ভ্রমণ কর বাবদ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করেছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ পর্যটন খাতে এর সামান্য অংশও পুনর্বিনিয়োগ করা হয়নি। এইচ এম হাকিম আলী বলেন, “একটি খাত থেকে এত আয় করে সেই খাতেই সামান্য বাজেট না রাখা দূরদর্শিতার অভাব।”
এই অবস্থাকে “আর্থিক বৈষম্য” আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, "বাজেট শুধুই রাজস্ব আদায়ের তালিকা নয়, এটি সম্ভাবনার রূপরেখা। পর্যটন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিশ্চিত করা গেলে এই খাত থেকেই বহু কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।"
বিহা’র প্রস্তাবিত বাজেট সুপারিশ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বিহা সরকারের কাছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করেছে:
১. ভ্যাট হ্রাস: বর্তমানে হোটেল ও পর্যটন খাতে ১৫% ভ্যাট কার্যকর রয়েছে, যা উচ্চ। বিহা এই হার কমিয়ে ৭ শতাংশ বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে।
২. নগদ প্রণোদনা: বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে ৫% নগদ প্রণোদনা দিলে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।
৩. কর স্থগিতকরণ: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই অর্থবছরে কর্পোরেট কর, বেতনভিত্তিক আয়কর, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি স্থগিত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
৪. এসআরও বহাল: নতুন হোটেল নির্মাণ ও বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২০২২ সালের এসআরও নং ১৩৬-আইন/২০২২/৮৪/কাস্টমস বহাল রাখার প্রস্তাব করেছে বিহা।
৫. অ্যালকোহল আমদানিতে শুল্ক হ্রাস: বর্তমানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা—২৫০% থেকে ৫৯৯% পর্যন্ত আমদানি শুল্ক। বিহা তা ১০০%–এর নিচে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে।
পর্যটন খাতকে জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় আনতে হবে
এইচ এম হাকিম আলী বলেন, “পর্যটন এখন আর শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক শিল্প। এটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখেছি—পাকিস্তান, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কা কীভাবে পরিকল্পনা ও বাজেট সহযোগিতায় পর্যটনে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে?”
তাঁর মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন এখনো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়, ফলে অনেক এলাকায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তিনি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদাহরণ টেনে বলেন, "পর্যটন হবে টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক—এটাই হওয়া উচিত জাতীয় নীতির লক্ষ্য।"
ই-ভিসা, মার্কেটিং এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের দাবি
পর্যটনে বিদেশি পর্যটক আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ই-ভিসা ব্যবস্থা চালু করা। বিশ্বের অনেক ছোট ছোট দেশেও আজ ই-ভিসা কার্যকর, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণে সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটিংয়ের ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, “যদি ভ্রমণ কর থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আয় হয়, তবে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকা এই খাতে বিনিয়োগ করাই যৌক্তিক। কারণ পর্যটনের জন্য খরচ করা প্রতিটি টাকা দেশে দশ গুণ আয় এনে দিতে পারে।”
ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব যথার্থ হবে বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসার বিকাশেও পর্যটন পারে বিশেষ অবদান রাখতে। বিশ্বে পর্যটন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনন্য। ১০ কর্মের একটি পর্যটন এবং গ্লোবাল জিডিপিতে ৯ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে তিনের কাছাকাছি। খাতটি পরিবেশবান্ধব। ধূম্রবিহীন শিল্প হিসেবে দেখা হয় পর্যটনকে। বাংলাদেশে এই খাতটি নিয়ে একটি যথাযথ মহাপরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। এটিই যথার্থ সময় বিষয়টি নিয়ে ভাবার এবং পদক্ষেপ নেওয়ার। কারণ ইউনূসের দেশে ইউনূসের তত্ত্বের ভিত্তিতে পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে—এই সংবাদ যথেষ্ট বিদেশিদের আকর্ষণ করা। অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন উন্নয়নে সব অংশীজন, স্থানীয় সম্প্রদায়, ব্যবসায়ী এবং পর্যটক যেন এই শিল্পে অংশগ্রহণ করতে পারে। পর্যটনসম্পদ ব্যবহারে সচেতনতা এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীজন।
বিহা মনে করে, সরকারের দায়িত্ব এখন শুধু বাজেট ঘোষণা নয়—একটি পর্যটনবান্ধব, পরিবেশসম্মত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপরেখা বাস্তবায়ন করা। এইচ এম হাকিম আলী বলেন, “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। পর্যটনকে দেখতে হবে জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে। তাহলেই এ শিল্প এগিয়ে যাবে,