এভারেস্টের চূড়ায় শাকিল
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫ ১৬:০২ পিএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৫ ১৬:৩৪ পিএম
এভারেস্টের চূড়ায় ইকরামুল হাসান শাকিল ছবি: ইকরামুল হাসান শাকিলের সৌজন্যে
গায়ে পর্বতারোহণের জ্যাকেট, পায়ে ক্লাইম্বিং বুট, মুখে অক্সিজেন মাস্ক আর হাতে লাল–সবুজ পতাকা উঁচিয়ে ইকরামুল হাসান শাকিল বসে আছেন বরফঢাকা পর্বতের চূড়ায়। অভিযানের তিন দিন পর এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের এই ছবি প্রকাশ করলেন তিনি।
আজ ২২ মে বেলা ১টা ৫ মিনিটে নিজের ফেসবুক পেজে এভারেস্টের চূড়ায় বসে থাকা ছবিটির সঙ্গে অভিযানের অভিজ্ঞতাও সংক্ষেপে লিখেছেন ইকরামুল হাসান। সেখানে বলেছেন, ১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ছয়টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই- আমি তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।
এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর উত্তাল খরস্রোতা ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপ একেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি। অক্সিজেনশূন্য উচ্চতায় কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্কবদ্ধ মুখে প্রতিবারই মনে হয়েছে, ‘আর পেরে উঠবো না।’ কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
এভারেস্ট জয়ের এই অভিযান ছিল “সি টু সামিট” নামের একটি বৃহৎ মিশনের অংশ। যার মূল লক্ষ্য ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পর্বতশিখর পর্যন্ত এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, " পৃথিবী আমাদের, আমাদেরই দায়িত্ব প্লাস্টিক দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টিকিয়ে রাখা আমাদের ভবিষ্যৎ।" আমার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্র সৈকত থেকে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে সাগর, সমতল, পাহাড়ের জীবন। আমি সেই দূষণ আর পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই পর্বতমুখী হয়েছিলাম, যেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে বলতে পারি- "আমরা যদি পাহাড় জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাকেও জয় করতে পারি।"
পর্বতারোহণ আমার কাছে কেবলই অ্যাডভেঞ্চার নয়। এটি দায়িত্ব, প্রতিবাদ এবং প্রজন্মের প্রতি এক প্রতিজ্ঞা। সমুদ্র থেকে শুরু করে বরফচ্ছন্ন শিখরে উঠে আমি বলতে চেয়েছি, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সময় এখনই। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, কাল হয়তো কোনো এভারেস্টই থাকবে না, থাকবে না আমাদের হাঁটার মতো পথ, বাঁচার মতো বাতাস। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কেঁদেছি-কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে, আর দায়িত্ববোধে। এই আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের, আর সেই সকল তরুণের যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর। এটা তাঁদের, যারা বিশ্বাস করেছিল আমার স্বপ্নে। এটা তাঁদের, যারা আমাকে শিখিয়েছে, “অসম্ভব” শব্দটা শুধুই একটি দেরিতে মানা ব্যর্থতা। এভারেস্টের চূড়া থেকেই বলছি- সাহস থাকলে, পরিশ্রম থাকলে, আর দেশের জন্য ভালবাসা থাকলে, কোনো স্বপ্নই দূর থেকে যায় না। আমার যাত্রা থেমে যায়নি। এটি কেবল শুরু। কারণ “সি টু সামিট” কেবল একটি অভিযান নয়, এটি একটি বার্তা, একটি বিপ্লব।
তাশি গ্যালজেন শেরপা, আমার শুধু গাইড না। একজন ভাই ও বন্ধু।তার কারণেই এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি। বছর দুয়েক আগে দুজনে পরিকল্পনা করেছিলাম একসাথে দুইটা রেকর্ডময় অভিযান করব। সেটাই করেছি, আমি 'সি টু সামিট' আর গ্যালজেন ২০ দিনে চারবার এভারেস্ট সামিট। আমারটা সফল ভাবে শেষ এবং তার তিনবার শেষ হয়েছে। এখন সে আছে ৪র্থ সামিটের পথে। আশাকরি ২৩ তারিখ সকালে নেপালের পতাকা ওড়াবে।ওর শুভকামনা।আমি কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সকল মানুষদের যারা এই অভিযানের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমাকে এগিয়ে নিতে। একবারের জন্য হাল ছেড়ে দেয়নি, আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন এবং সাহস যুগিয়েছেন।
ইকরামুল হাসান ৯০ দিনের মধ্যে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন। তবে তার আগেই ৮৪তম দিনে এভারেস্ট শিখরে পৌঁছান। এ অভিযান শেষ করতে প্রায় ১ হাজার ৩৭২ কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন।