× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস

তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে

সঞ্জয় চৌধুরী

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ১৩:২০ পিএম

তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে

বাংলাদেশে শীত মৌসুম এলেই অতিথি পাখির নাম শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। দেখাও যায় দেশের বিল, ঝিল, হাওর, বাঁওড়, নদীনালাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া, পত্র-পত্রিকায় এসব অতিথি পাখির নাম বারবার ঘুরেফিরে আসে সচিত্র। এই অতিথি পাখিরাই মূলত পরিযায়ী পাখি। যাকে অন্যভাবে পরিব্রাজক পাখি আবার কখনও কখনও যাযাবর পাখি নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে এদেরকে মাইগ্রেটরি বার্ডস বলা হয়।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, পরিযায়ী প্রজাতি অর্থ ওই সব বন্যপ্রাণী, যারা এক বা একাধিক দেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় আসা-যাওয়া করে থাকে।

আমাদের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে পরিযায়ী পাখিগুলো মূলত রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে আসে। তবে পরিযায়ী পাখি বিশেষজ্ঞের মতে এরা মূলত উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে আসে। তাহলে বলা যায় উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা ও হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের এলাকা থেকে পাখিগুলো বাংলাদেশে আসে মূলত নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। বাংলাদেশে বর্ষার শেষে এবং শীতের আগে থেকেই এসব পাখি আসা শুরু করে এবং মার্চ মাসের শেষ নাগাদ থাকার পর আবার ফিরে যায়। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পাখিগুলোর আসার মূল কারণ হলো, তারা যে অঞ্চল থেকে আসে সেখানে শীতে বরফে সব ঢেকে যাবে এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয়। তাই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য হাজার হাজার কিলোমিটার দূরত্ব ডানায় ভর করে পেরিয়া আসে বাংলাদেশের মত কম শীতল অঞ্চলে।

শীত মৌসুমে বাংলাদেশের জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন কচিপাতা, শামুক, ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ ইত্যাদি হয়ে ওঠে এদের প্রধান ও প্রিয় খাবার। এই মৌসুমে জলাশয়গুলোতে পানি কমে যায়, ফলে খাদ্য সংগ্রহ সহজ হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখিদের কাছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার বিভিন্ন জলাশয়ে শীত সৌসুমে কম-বেশি এই অতিথি পাখি দেখা যায়। তবে চরকুকরী মুকরী, দুবলার চর, ঢালচর, নিঝুম দ্বীপেও দেখা যায় পরিযায়ী পাখি। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিরাজগঞ্জের হুরা, নীলফামারীর নীল সাগরেও চোখে পড়ে এদের। আবার মিরপুর চিড়িয়াখানার লেকসহ ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়ে এসব পাখি প্রচুর চোখে পড়ে। শীতকালে অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে ভিড় জমান অতিথি পাখি দেখার জন্য।

প্রায় ৭০০-এর অধিক প্রজাতির পাখি দেখা যায় বাংলাদেশে। তার মধ্যে পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। ফলে এই সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে পরিযায়ী পাখির গুরুত্ব কতটা। এরা যে কেবল অতিথি পাখি হিসেবে আমাদের পরিবেশে আসে তা নয়, বরং অল্প সময়ের এই পরিযায়নে আমাদের পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য রাখে নানা অবদান। অতিথি হিসেবে এসেও এ যেন ঋণ শোধ করার মতো ব্যাপার।

ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধনে এরা পারদর্শী। ফলে এটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনে বাংলাদেশের কৃষিতে। সেই সঙ্গে ফুল ও শষ্যের পরাগায়ন ঘটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি এদের বিষ্ঠা কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ও মাছের খাদ্য হিসেবে কাজে আসে। পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এদের ঠোঁট ও বিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন বীজ এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। এমনই অগনিত উপকার করে চলেছে এই অতিথি পাখিরা।

বাংলাদেশ পরিযায়ী পাখির জন্য 

কতটা অতিথিপরায়ণ

বিশ্বব্যাপী আমাদের একটি সুনাম ছড়িয়ে আছে। তা হলো বাঙালি জাতি অতিথিপরায়ণ। জাতির এই সুনাম পরিযায়ী পাখির ক্ষেত্রে কতটা সঠিক? বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে অতিথি পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে ২ লাখের নিচে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৪, এই ২০ বছরে প্রায় ৬ লাখ পরিযায়ী পাখির আসা কমেছে আমাদের এই ভূমিতে।

আমরা কি আমাদের অতিথিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি? নাকি তাদের নিধন ও শিকারের উৎসবে মেতে উঠি আমরা? এ দেশের এক শ্রেণির মানুষ এই পরিযায়ী পাখি শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ উচ্চ দামে বিক্রি করে, কেউ মাংসের স্বাদ গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। শিকারের বিক্রিত নেশা পেয়ে বসে কাউকে কাউকে।

অথচ পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের আইন রয়েছে আমাদের দেশে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২, আইনের ধারা ৩৮ এর (১ ও ২) অনুযায়ী পরিযায়ী পাখিকে আঘাত করা, দখলে রাখা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মাংস ভক্ষণ, এয়ারগান দিয়ে শিকার, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ধরা, প্রজননের সময় বিরক্ত, ডিম নষ্ট ও হত্যা করা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তা সত্ত্বেও বন্ধ নেই পাখি শিকার।

তবে আশার কথা এই, দেশে আগের চেয়ে পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দেশের কোথাও পাখি শিকারের খবর পাওয়া গেলে জনসাধারণ সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্নভাবে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন।

পরিযায়ী পাখি সুরক্ষায় আমাদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নকারী সংগঠনগুলোকে বেশি তৎপর হতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের পরিযায়ী পাখি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তথা পরিবেশ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগই পারে বাংলাদেশকে পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থলে রূপান্তর করতে। এই পরিযায়ী পাখির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার পালিত হয় বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। এ বছর গত ১০ মে ‘শেয়ার্ড স্পেসেস : ক্রিয়েটিং বার্ড-ফ্রেন্ডলি সিটিজ অ্যান্ড কমিউনিটিজ’ অর্থাৎ ‘অংশীদারত্বের স্থান : পাখিবান্ধব নগর ও সমাজ গঠন’ প্রতিপাদ্য ধারণ করে দিবসটি পালিত হয় নানাভাবে। এখানে পাখি ও মানুষের সহাবস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাস তার কবিতায় বলেছেন- 

‘আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।

তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে?

তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে।’

কবির কবিতার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, আমাদের আকাশ থেকে পাখিদের ডানার ঘ্রাণ বিলিন হলে মূলত সংকটে পড়ব আমরাই।


লেখক : শিক্ষক ও পরিচালক, গ্রিন ইকো

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মারুফ কামাল খান

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা