অরণ্য ইমতিয়াজ
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ১৩:১৭ পিএম
টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ারের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতের তৈরি হস্তশিল্প ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য। দেলদুয়ার উপজেলার বর্ণী, প্রয়াগজানী ও কোপাখী গ্রামে বংশপরম্পরায় বাঁশের তৈরি হস্তশিল্পের কাজ করে আসছেন এ হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। এ শিল্পের উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করছেন উপজেলার অনেকে। বাঁশ ও বেতের তৈরি হস্তশিল্পের জনপ্রিয়তার কারণে চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনই তৈরি হচ্ছে বেকারদের কর্মসংস্থানের। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে আরও সম্প্রসারণ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্মকর্তারা।
গ্রাম ঘুরে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বর্ণী, প্রয়াগজানী ও কোপাখী গ্রামের আড়াই শতাধিক পরিবার এ হস্তশিল্প তৈরির কাজে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এসব পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী তৈরি করছেন।
তাদের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন বর্ণী গ্রামের শাহআলম। তিনি প্রায় ৩২ বছর আগে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেন মা-বাবা কুটিরশিল্প। নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম দিয়ে কাজ করতে থাকেন। আস্তে আস্তে সাফল্যও পেতে থাকেন। সাফল্যের দেখা পাওয়ার পর তিনি অন্যদের জন্যও সাফল্যের দ্বার খুলে দেয়ার চেষ্টা করেন। নিজের বাড়ি ছাড়াও এলাকার আরও অনেকের বাড়িতে এ শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। সেখানে মহিলারা যুক্ত হন তার কাজে। এভাবে চলতে চলতে বর্তমানে তিনি প্রায় ৩৫টি পরিবারকে তার হস্তশিল্প তৈরির আওতায় নিয়ে এসেছেন।
এক সময় তার তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প বিদেশে রপ্তানি হতো। এখন নানা সমস্যার কারণে আর রপ্তানি করতে পারছেন না। দেশের ভেতরেই সরবরাহ করছেন।
সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেয়ে তিনি অনেকটা আক্ষেপ করে করে বলেন, কোনোদিন সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি, হয়তো পাবও না। নিজের পরিশ্রমেই এগিয়ে যাচ্ছি। নিজে কাজ করি, নিজে চলি। সঙ্গে আরও কয়েকজনকে চলতে সহযোগিতা করছি। আরেক কারুশিল্পী নূরুন্নবী। তিনি বর্ণী দক্ষিণ পাড়ায় ‘নূরুন্নবী ব্যাম্বো ক্রাফট’ নামে একটি কারখানা গড়ে তুলেছেন। সেখানে প্রায় ৬০ জন নারী-পুরুষ কাজ করে। অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এ শিল্পের কারণে। প্রায় সবাই এখন বাঁশ-বেতের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। আর্থিকভাবেও হচ্ছেন সাবলম্বী। তারা বিভিন্ন ধরনের বাস্কেট, টেবিল ল্যাম্প, প্লেস ম্যাট, বিভিন্ন ধরনে ট্রে, মোড়া, ফলের ঝুড়ি, টিস্যু বক্স, গয়নার বাক্স, জানালার পর্দা, ওয়েস্ট পেপার ঝুড়ি, ড্রিংকস বোতলের ঝাড়সহ নানা ধরনের সৌখিন পণ্য তৈরি করছেন। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবেও তৈরি করা হচ্ছে এসব পণ্যসামগ্রী।
স্থানীয় বাজার ছাড়াও রাজধানী ঢাকার বড় বড় শপিংমল ও বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে দেলদুয়ারের বাঁশ ও বেতের তৈরি হস্তশিল্প। বিভিন্ন রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে বলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান।
কারুশিল্পী নূরুনবী জানান, নিজেদের বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে বাঁশ, বেতশিল্পের সঙ্গে কয়েকশ পরিবার জড়িত রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বংশপরম্পরায় তিনি হস্তশিল্পের কাজ করছেন। ২০০৪ সালে তিনি ‘নূরুন্নবী ব্যাম্বো ক্রাফট’ কারখানাটি গড়ে তুলেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি অর্ডার পেয়েছেন এবং তা সঠিকভাবে সরবরাহও করেছেন। যখন অর্ডার বেশি হয় তখন কারখানায় বেশি কর্মচারী কাজ করে। অন্য সময় প্রায় ৬০ জনের মতো লোক কাজ করে। হস্তশিল্প কারখানা শ্রমিক রহমান মিয়া বলেন, আমাদের তৈরি পণ্য দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। প্রতি মাসে গড়ে একজন ৮-১০ হাজার টাকার মতো আয় করি। এদিয়েই আমাদের সংসার চলে। নারী শ্রমিক রাশেদা আক্তার বলেন, ২০ বছর ধরে এ কাজ করছি। পরিবারের কাজ শেষে বিভিন্ন ধরনের বেতের কাজ করি। আমাদের কাজ হচ্ছে বুনানো, চাপানো, পরিচ্ছন্নসহ বিভিন্ন কাজ। এখানে কাজ করে আমার ছেলেমেয়েকে পড়শোনা করাচ্ছি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো আছি। নূরুন্নবী বলেন, বেত-বাঁশের বিভিন্ন প্রকার জিনিস সম্পূর্ণ হাত দিয়ে তৈরি করে থাকি। কোনো ধরনের মেশিন দিয়ে তৈরি হয় না। সরকার যদি আমাদের মেশিন ও মেশিন ব্যবহারের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করত, তাহলে আরও মানসম্পন্ন জিনিস আমরা তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারতাম।
টাঙ্গাইল জেলা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম বলেন, দেলদুয়ারে বাঁশ-বেত দিয়ে অনেকেই হস্তশিল্প তৈরি করছে। তারা ভালো সাফল্য অর্জন করছে। ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতের শিল্পের সম্প্রসারণ করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। কেউ যদি ক্ষুদ্র ঋণের প্রয়োজন অনুভব করেন তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে।