অরণ্য ইমতিয়াজ
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫ ১৩:১৬ পিএম
টাঙ্গাইলে অবস্থিত প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টার
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। একটা কঠিন আঘাত, একটি কঠিন স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেয় শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে। ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। তাকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন তার স্ত্রী ডা. জাহিদা বেগম সুইটি। তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাদের স্বপ্ন পূরণ হিসেবে টাঙ্গাইলে যাত্রা শুরু করে ‘প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টার’। এখানে অটিস্টিক শিশুদের স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়।
একসময় টাঙ্গাইলে বিশেষ রোগে আক্রান্ত (অটিজম) শিশুদের চিকিৎসা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসা নিতে হতো ঢাকায় গিয়ে। সেখানে অবস্থান করে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হতো। এখন আর ঢাকায় ছুটতে হয় না। টাঙ্গাইলে ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রতিষ্ঠিত প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টারে অটিজম শিশুদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম হলেন শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (শিশু বিভাগ)। তার স্ত্রী ডা. জাহিদা বেগম সুইটি হলেন একই হাসপাতালের প্রভাষক (এনাটমি বিভাগ)। ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি খুলে জানান ‘প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার গল্প।
২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা। তার স্ত্রী প্রথম সন্তান প্রসব করেন। সন্তানের নাম রাখেন জাইদি। সন্তানকে নিয়ে হাসি-খেলার মধ্য দিয়ে তাদের সময় কাটতে থাকে। দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে যায়। তিনি লক্ষ করেন, জাইদি অতিরিক্ত ভয় পায়। সব কাজে অতিরিক্ত সচেতন, ওর খেলনার সামগ্রী জুতা, পাতিল, চামচ। সময় চলে যায় কিন্তু সে কথা বলে না। সবাই বলেন, অনেকে দেরিতে কথা বলে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। শুরু হয় জাইদিকে নিয়ে যুদ্ধ। এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার দেখানো। চিকিৎসার জন্য অনেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সবাই বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। কিছু কমন কথা এবং প্রচুর ওষুধ। কিছুতেই কিছু হলো না। ব্যতিক্রম ছিলেন একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তিনি প্রথম বললেন, আপনার ছেলে সবার থেকে একটু আলাদা, ওকে ঢাকা নিয়ে যান। এখানে এর চিকিৎসা হবে না। তারপর তিনি বললেন, আপনার ছেলে অটিস্টিক। এ কথা শুনে আঘাত পেলেও তারা স্বামী-স্ত্রী কেউ ভেঙে পড়েননি। তারা দুজনইতো ডাক্তার।
সেদিনই ঢাকা চলে গেলেন। বিভিন্ন সেন্টারে যোগাযোগ করলেন। অবশেষে জাইদির চিকিৎসা শুরু হলো। মিরপুর সিআরপিতে জাইদিকে অকুপেশনাল ও স্পিচ থেরাপি দেওয়া শুরু হলো। ভর্তি করা হলো ঢাকা প্রয়াশ স্কুলে। অনেক কঠিন যুদ্ধ। ঢাকা আসা-যাওয়া, থাকা, প্রচুর অর্থ খরচ। এভাবে ঢাকাতে তিনটা বছর কাটে।
এদিকে নিজেদের চাকরি, সংসার, ছোট বাচ্চা, সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন তারা। ফিরে আসেন টাঙ্গাইল। কিন্তু এখানে কোনো স্পেশাল স্কুল স্পিচ থেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি নেই।
তিনি শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হওয়ায় প্রায়ই লক্ষ করতেন, তার ছেলের মতো টাঙ্গাইলে আরও অনেক শিশু রয়েছে। তাদের অভিভাবক সন্তানের চিকিৎসা ঠিকভাবে করাতে পারছেন না। ঢাকায় নিয়মিত চিকিৎসা করানো অনেকের জন্য কঠিন। তা ছাড়া এ চিকিৎসা ব্যয়বহুলও। এ অবস্থায় তার মাথায় একটি স্বপ্ন বাসা বাঁধেÑ টাঙ্গাইলে এরকম একটা থেরাপি সেন্টার হলে কেমন হয়! যার মাধ্যমে তার সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের সন্তানও চিকিৎসা পাবে। শুরু করে দেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ।
২০১৬ সালে টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়াতে শুরু করেন স্বপ্ন পূরণের কাজ। নাম দেন ‘প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টার’। ২০১৮ সালে এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন পায়।
ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের দেশে অকুপেশনাল এবং স্পিচ থেরাপি এর সংখ্যা খুবই কম। অনেক কষ্টে থেরাপিস্ট পেয়ে গেলাম। তারপর আল্লাহর অশেষ রহমতে একজন স্পেশাল এডুকেশন শিক্ষক পেলাম। আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে প্রত্যাশা। বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহে দুজন প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট আসছেন। তাদের পাশাপাশি লোকাল চারজন কাজ করছেন।
আগে শহরের সাবালিয়াতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেন্টারের কাজ চালিয়ে গেলেও বর্তমানে তার নিজস্ব জায়গায় পরিকল্পিত ভবনে প্রত্যাশা স্পেশাল স্কুল অ্যান্ড থেরাপি সেন্টারের কাজ করছেন।
বিশেষ শিশু যারা ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, অস্বাভাবিক আচরণ করে, ঠিকমত হাঁটাচলা করতে পারে না, অনুভূতির সমস্যা, অতিরিক্ত ভয় পাওয়া, অতিরিক্ত অস্থির প্রকৃতিরÑ তাদের অতিযত্ন সহকারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্ট দ্বারা থেরাপি দেওয়া হয় এই সেন্টারে। এখানে ভর্তি প্রায় ১৮ জন শিশুর নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল শহর এবং শহরের বাইরে থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন শিশু এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানায় সেন্টার কর্তৃপক্ষ। এই সেন্টারের খবর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে টাঙ্গাইলে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। রোগীদের চাহিদা মতো চিকিৎসা দেয়ার জন্য সেন্টার কর্তৃপক্ষ সাধ্যের মধ্যে থেকে নানা উপকরণ ক্রয় করছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য সব ধরনের উপকরণের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করাতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেন অভিভাবকরা। তাদের প্রত্যাশা, এই সেন্টারের ব্যাপ্তি আরও বড় হবে। আরও বেশি বেশি রোগী এখান থেকে সেবা পাবে। অভিভাবক জুথী আক্তার বলেন, তার সন্তান কথা বলতে ও লিখতে পারে না। তিনি তিন বছর ধরে এই সেন্টারে সন্তানের চিকিৎসা করাচ্ছেন। ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, টাঙ্গাইলে অটিজম শিশু অনেক রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই হয়তো ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারে না। কোথায় চিকিৎসা করাবে সে খবরই হয়তো তারা জানে না। প্রত্যাশা সেন্টারের প্রচারণা থাকলে মানুষ অটিজম শিশুদের চিকিৎসার সন্ধান পেত।
টাঙ্গাইল শহরের বেবিস্ট্যান্ড এলাকার আরেক অভিভাবক তানিয়া আক্তার। তার সন্তানের বয়স আড়াই বছর। নয় মাস বয়সে তার ছেলে একটু একটু করে কথা বলতো। কিন্তু সে সময় তাকে মোবাইল দেখানো হতো। পরে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে আগের কথাগুলো ভুলে যায় এবং এখন আর কোনো কথাই সে বলে না। তিনি বলেন, এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানতে পারি প্রত্যাশার কথা। ওই প্রতিবেশীর সন্তানও এখানে চিকিৎসা করে ভালো হয়েছে। তাই আমিও সন্তান নিয়ে এসেছি।
প্রত্যাশার প্রতিষ্ঠাতা ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আপনার বিশেষ শিশুটিকে আড়ালে না রেখে প্রকাশ করুন, বিকশিত হবেই।’ এটাই আমাদের স্লোগান এবং এই মূলমন্ত্রটিকে ধারণ করেই আমাদের অগ্রযাত্রা। শারীরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করা।’
তিনি আরও বলেন, এ স্কুল ও সেন্টারের কাজ হচ্ছে ‘নো লস, নো প্রফিট’ ভিত্তিতে। তার মানে এখান থেকে কোনো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় না। থেরাপিস্ট, কর্মচারীদের বেতন ও স্কুলের খরচের জন্য রোগীর স্বজনরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ পরামর্শ ফি হিসেবে প্রদান করেন।
ডা. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের প্রত্যাশা, বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুরা সমাজে যেন অবহেলিত না হয়। ওরাও যেন সবার হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।