× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস

থ্যালাসেমিয়ায় সচেতনতা

ড. মাহবুবা শারমিন

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৫ ১২:৪৭ পিএম

থ্যালাসেমিয়ায় সচেতনতা

মফস্বলের একটি পরিবারে বেড়ে উঠছে সেলিম ও সোলায়মান নামক দুই শিশু। একজনের বয়স ৭, একজনের ১১। দুর্ভাগ্যজনভাবে দুই ভাইই থ্যালাসেমিয়া নামক জটিল রোগে আক্রান্ত। তাদের একজন ভাইও এই অসুখে মারা যায়। জটিল এই রোগ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই কম। শরীর রক্তশূন্য হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত রক্ত দিতে হয় তাদের। দুই ভাইয়ের দাদাও এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই পরিবারটির মতো বাংলাদেশে আরও অনেক পরিবার আছে যাদের রোগটি সম্পর্কে ধারণা সেভাবে নেই, যার কারণে মৃত্যুবরণ করছে এই সংখ্যাটা নেহাতই বাড়ছে। 

২০২৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপের হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে জনসংখ্যার মধ্যে ১১.৪% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বিশ্বের অন্য অনেক দেশ বা অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বাহকের এই হার তুলনামূলকভাবে বেশি।

ইউরোপিয়ান জার্নাল অব হেমাটোলজিতে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক গবেষণাপত্রে উঠে আসে যে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার সবচেয়ে বেশি। ওই গবেষণাপত্রের হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থ্যালাসেমিয়া বাহকের হার সবচেয়ে বেশি মালয়েশিয়ায়, ১২.৮%।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মিশরে এই হার সবচেয়ে বেশি, ৯-১০%। (তথ্যসূত্রÑ বিবিসি বাংলা) প্রতিবছর ৮ মে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হয়। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Together for Thalassaemia: Uniting Communities, Prioritising Patients’। 

থ্যালাসেমিয়া কী 

‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটি গ্রিক শব্দ থ্যালাসা থেকে আগত, যার অর্থ সমুদ্র। একসময় ধারণা করা হতো শুধু সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষেরই থ্যালাসেমিয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অঞ্চলগত বা জাতিগত বিশেষত্বের কারণে বিশেষ এলাকার মানুষের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার হার বেশি হয়ে থাকে। 

বাবা ও মা দুইজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০%, বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫%, সুস্থ সন্তান জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫% প্রতিটি প্রেগনেন্সিতে। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুপাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। 

কী কারণে হয় 

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। মানবদেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। প্রতি জোড়ার অর্ধেক মায়ের এবং বাকি অর্ধেক বাবার কাছ থেকে আসে। ১৬ নং ক্রোমোজোম থাকে আলফা জিন এবং ১১ নং ক্রোমোজোম থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে, যা অনেক অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ বা ১১ নং ক্রোমোজোমের আলাদা অথবা বিটা জিন সঠিকভাবে অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না। ফলে আলফা বা বিটা নামক গ্লোবাল চেন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ত্রুটিপূর্ণ হয় বলে লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায় এবং রক্তস্বল্পতা ও জন্ডিস দেখা যায়। 

কত ধরনের হয় 

রোগীর ব্লাড নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে বা ক্লিনিক্যালি থ্যালাসেমিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমনÑ থ্যালাসেমিয়া মেজর (অতি মাত্রা), মাইনর বা বাহক (অল্প মাত্রা) এবং ইন্টারমিডিয়া (মধ্যম মাত্রা)। 

থ্যালাসেমিয়া বাহক কারা 

বিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবাদানকারী সংস্থা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী থ্যালাসেমিয়া বাহক যে কেউ হতে পারেন। থ্যালাসেমিয়া বাহকরা ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করলেও তারা নিজেরা কখনও এতে আক্রান্ত হন না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় থ্যালাসেমিয়া জরিপ ২০২৪-এর হিসাব অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যার মধ্যে ১২-১৪% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বিশ্বের অন্য অনেক দেশ বা অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার বাহকের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। 

উপসর্গ/লক্ষণ 

থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জন্মের ছয় মাস বয়স থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। যেমনÑ শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, জন্ডিস, লিভার, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, মুখের গঠন বদলে যাওয়া ইত্যাদি। 

কীভাবে জানা যাবে কেউ বাহক/রোগী কি না 

হেমাটোলজি অটো এনালাইজার মেশিনে রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক বা থ্যালাসেমিয়া রোগী কি না তা ধারণা করা যায়। এরপর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেব্রিস পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা রোগী নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ডিএনএ অ্যানালাইসিস পরীক্ষা করতে হয়। 

চিকিৎসা 

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি মাসেই রক্ত নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেওয়ায় ও পরিপাক নালি থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের নানা জটিলতা দেখা যায়। তাই একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীর চিকিৎসা হলো রক্ত সঞ্চালন ও আয়রন চিলেশন। তবে বর্তমানে ওরাল ওষুধ/ট্যাবলেট আমরা হেমাটোলজিস্টরা প্রেসক্রাইব করে থাকি, যার ফলে রোগীদের ব্লাড সঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে। আয়রন চিলেশনের জন্য ওরাল ট্যাবলেট ইনজেকশন আছে। রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে আমাদের উচিত রোগীদের উপদেশ দেওয়া। তারা যেন কয়েকজন ডোনার সিলেক্ট করে রাখে যেন তারা সেসব ডোনারদের কাছ থেকেই ব্লাড নিতে পারে, যাতে অ্যান্টিজেন এক্সপোজার কম হয়। মনে রাখতে হবে রক্ত ফার্স্ট ডিগ্রি আত্মীয়র কাছ থেকে নেওয়া যাবে না। 

প্রতিরোধে করণীয় 

যেহেতু মা বাবা দুজনে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাই দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করতে হবে। একজন সুস্থ মানুষ থ্যালাসেমিয়া বাহক বা থ্যালাসেমিয়া রোগীকে বিয়ে করলেও সন্তান রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

দুজন বাহকের মধ্যে যদি বিয়ে হয়েই যায়, তবে বাচ্চা পেটে আসার আট থেকে চৌদ্দ সপ্তাহের মধ্যে মায়ের জরায়ুর পানি নিয়ে করিন্তটনিক ভিলাস স্যাম্পলিক পরীক্ষা এবং ১৪-১৮ সপ্তাহের মধ্যে অ্যামনিওসেন্টেসিস করে জানা যাবে বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার রোগী কিনা। যদি বাচ্চা রোগী হয়, তাহলে তারা অনুমতি নিয়ে গর্ভপাত করতে পারে। তবে বাচ্চা বাহক হলে স্বাভাবিক জন্মদানে কোনো বাধা নেই। 

উন্নত চিকিৎসা 

থ্যালাসেমিয়া রোগী যাদেরকে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা ডোনারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা এলোজেনিক বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট (বিএমটি) বা হ্যাপ্লো ট্রান্সপ্ল্যান্ট যা দিয়ে ৮৭-৯০ শতাংশ সম্পূর্ণ রোগ নিরাময় সম্ভব। 

খাদ্য উপদেশ 

থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর রোগীর খাবারের উপদেশ এক নয়। বাহকের খাবার স্বাভাবিক মানুষের মতো, আয়রন জাতীয় খাবার খেতে পারবে এবং আয়রনের ঘাটতি হলে আয়রন জাতীয় খাবার এবং ওষুধ খেতে হবে। আর থ্যালাসেমিয়া রোগী যাদের সব সময় রক্ত ভরতে হয়, তারা আয়রন জাতীয় খাবার কম খাবে এবং প্রয়োজনে আয়রন কমানোর ওষুধ দিতে হয়। বাহক যখন গর্ভবতী হবে, তখন তারা শরীরে আয়রনের চাহিদা অনুযায়ী আয়রন জাতীয় খাবার ও ওষুধ খাবে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট 

বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক বলে ধারণা করা হয়। প্রতিবছর অনেক থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও এই রোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ এবং কর্মক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা 

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য দেশেই বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক পিজি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল, বিভাগীয় হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল যেসব হাসপাতালে হেমাটোলজি ডিপার্টমেন্ট আছে এবং শিশু ডিপার্টমেন্ট আছে, সেসব হাসপাতালে সরকারিভাবে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা হয়। প্রাইভেটভাবে থ্যালাসেমিয়া সমিতি, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন এবং হেমাটোলজি বিশেষজ্ঞগণ শিশু হেমাটোলজি বিশেষজ্ঞগণ চেম্বারে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য রোগ। নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন, আয়রন চিলেশন, ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ রাখা গেলেও এর সঙ্গে মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ জড়িত। তাই প্রতিটি মানুষের উচিত থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও অন্যকে সচেতন করা। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে ‘থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং’-এর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব। 


লেখক পরিচিতি : এমবিবিএস, এফসিপিএস (হেমাটোলজি), ব্লাড ডিজিজ, থ্যালাসেমিয়া, ব্লাড ক্যানসার ও মেডিসিন স্পেশালিস্ট 

ডিপার্টমেন্ট অব হেমাটোলজি 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা